সোনালি অতীতের উত্থান

পাট থেকে কেবল দড়ি বা চটের বস্তাই নয়, তৈরি হচ্ছে পোশাকসহ নানা রকম পণ্য। ছবি: প্রথম আলো
পাট থেকে কেবল দড়ি বা চটের বস্তাই নয়, তৈরি হচ্ছে পোশাকসহ নানা রকম পণ্য। ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের উত্থান-পতনের সঙ্গে পাট আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। কখনো এই বাঁধন শক্ত হয়েছে। ধরে রেখেছে এ দেশের কৃষক আর অর্থনীতির জোয়াল। কখনো হয়েছে শিথিল। কিন্তু পাট এই ভূখণ্ডের মানুষের মতোই নানা দুর্বিপাক আর বিপর্যয় থেকে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছে।

১৮৫০ থেকে ১৯৫০ সাল ছিল বাংলায় পাট চাষের উত্থানপর্ব। ওই সময়ে বিশ্বজুড়ে শিল্প বিপ্লবের সঙ্গী হয়েছিল বাংলার পাট। পণ্যের মোড়ক ও ভারী পণ্য বাঁধার জন্য পাট হয়ে ওঠে আবশ্যক উপকরণ। ১৮৫৩ সালে রাশিয়ার সঙ্গে অটোমান সাম্রাজ্যের যে যুদ্ধ হয়, যা ক্রিমিয়ার যুদ্ধ নামে পরিচিত, তা বাংলার পাটের চাহিদা বাড়িয়ে দেয়। এরপর আর বাংলার পাট ও পাটচাষিদের পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৮৫০ সালে যেখানে বাংলা অঞ্চলে পাটের চাষ হতো মাত্র ৫০ হাজার একর জমিতে, ১৯০০ সালের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ লাখ একর। বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে পাটের এই উত্থান বাংলার কৃষকের হাতে নগদ টাকা এনে দেয়। সৃষ্টি হয় গ্রাম থেকে গঞ্জের। রাজধানীর বাইরে ছোট্ট মফস্বল শহরগুলোর জন্মের পেছনে পাট বিক্রির অর্থ জ্বালানি জুগিয়েছে। শহুরে বাবু আর জমিদার পুত্রদের বাইরে বাঙালি মধ্যবিত্তের সন্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচও ওই পাট থেকেই আসে।

বাঙালি মধ্যবিত্তের অর্থনীতি ও রাজনীতির সঙ্গে পাটের এই সম্পর্ক এখন অবশ্য সুদূর অতীতের বিষয়। ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার পাটে ব্রিটেনের ডান্ডি শহরের সমৃদ্ধি বা পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার পাটের টাকায় করাচি-লাহোরের উন্নয়নের প্রতিক্রিয়ায় উপমহাদেশের মানচিত্রের অনেক বদল হয়েছে। ব্রিটিশরা চলে গেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু আশি ও নব্বইয়ের দশকে এসে পাটের রমরমা পড়ে যেতে থাকে। পাটকলগুলোর একের পর এক লোকসান, ন্যায্যমূল্য না পাওয়া পাটচাষিদের বঞ্চনার বেদনা দেখে অনেকে ভেবেছিলেন বাংলার পাটের সূর্য বুঝি অস্ত গেল। এশিয়ার সবচেয়ে বড় পাটকল আদমজী বন্ধ হয়ে বিশেষ শিল্পাঞ্চলে পরিণত হলো। প্রধান রপ্তানিপণ্য হিসেবে পাটের জায়গা দখল করে নিল তৈরি পোশাক আর চিংড়ি। অবশেষে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এসে পাট খাত যেন আবারও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।

জন্মলগ্ন থেকে পাটকলগুলো শুধু দড়ি, বস্তা আর চটের ওপর নির্ভর করে এগিয়েছিল। দেশের একদল নতুন উদ্যোক্তা পাট সুতার কারখানা স্থাপন শুরু করলেন। ইউরোপের বাইরে মধ্যপ্রাচ্য-যুক্তরাষ্ট্র-চীন-জাপানে যাওয়া শুরু করে পাট। ২০০৭ সালে চিংড়িকে টপকে পাট দ্বিতীয় রপ্তানিপণ্যের আসনে উঠে আসে। বেসরকারি খাতের বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী পাট খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসে। পাট সুতার নতুন নতুন কারখানা স্থাপন হতে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যেন পাটের ললাটে লেখা। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ, বিশ্ব মন্দা ও কৃত্রিম আঁশের দাপটে আবারও মুখ থুবড়ে পড়ে পাট। বিদেশে পাটের দাম কমার প্রতিক্রিয়া পড়ে দেশে। বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়ে পড়েন, কৃষক দাম না পাওয়ার দুঃখে পাটে আগুন দেন। কমতে থাকে পাটের চাষও। এই খাতের সবার মধ্যে নেমে আসে হতাশা।

এভাবে চার-পাঁচ বছর মন্দার পর ২০১২ থেকে আবারও বিশ্বজুড়ে পাটের বাজারে সুবাতাস বইতে শুরু করে। উন্নত দেশগুলোতে কৃত্রিম আঁশের ব্যবহারের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে উঠতে থাকে। প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে পাটের ব্যবহারে বাড়তে থাকে সচেতনতা। এবার শুধু সুতা নয়, তৈরি পোশাক থেকে শুরু করে মোটরগাড়ির বডি, ব্যাগ, তৈজসপত্র, ঢেউটিনের মতো পণ্য-বহুমুখী পাটপণ্যের নতুন ক্ষেত্র বড় হতে থাকে। আবারও একদল নতুন তরুণ ও সৃজনশীল উদ্যোক্তা পাটের এই নবযাত্রার সঙ্গী হয়।

এই সময়ে সোনালি আঁশের নতুন স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে আসেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে একদল গবেষক। সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় তাঁরা পাটের নতুন জীবন দিতে এর জীবনরহস্য বা জিনের মানচিত্র উন্মোচনের অভিযানে নেমে পড়েন। ২০০৯ সালে শুরু করে ২০১০-এর মধ্যে তাঁরা পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করেন। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের একদল বিজ্ঞানীকে সঙ্গে নিয়ে বিজ্ঞানী মাকসুদ পাটের নতুন জাত উদ্ভাবনে নামেন। কিন্তু ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। বাংলাদেশের পাটের নতুন যাত্রা কি তবে থমকে গেল? অনেকে হতাশ হন। জীবনরহস্য উন্মোচনের সুফল কি তবে বাংলাদেশ পাবে না? মাকসুদুল আলমের উত্তরসূরিরা কি পারবেন বাংলাদেশের পাটের নতুন জাত, নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খোলার অর্ধসমাপ্ত কাজ শেষ করতে।

তিন বছর এ নিয়ে আশা-নিরাশার দোলাচল চলেছে। কিন্তু পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনের সাত বছরের মাথায় এই সাফল্যের প্রথম বাস্তব প্রয়োগ ঘটে। জিনপ্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে রবি-১ নামে পাটের একটি নতুন জাত উদ্ভাবন করলেন মাকসুদুল আলমের অনুসারীরা। শুধু উদ্ভাবনই নয়, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের চারটি গবেষণাকেন্দ্রের মাঠে ও কৃষকের জমিতে এটি চাষ করে সফলতা পাওয়া গেল। এর মধ্য দিয়ে পাটের নতুন যাত্রা শুরু হয়েছে। পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের একদল বিজ্ঞানীর নেতৃত্বে উদ্ভাবিত ওই জাত সাধারণ তোষা পাটের জাত থেকে কমপক্ষে ২০ শতাংশ বেশি ফলন দিয়েছে। এর উচ্চতা সাধারণ পাটের চেয়ে ২০ সেন্টিমিটার বেশি। আঁশের পরিমাণও বেশি ২০ শতাংশ। সাধারণ তোষা পাট ১২০ দিন পর কাটতে হয়। নতুন এই জাত ১০০ দিনে কাটা যাবে। ২০ দিন বেঁচে যাওয়ায় একই জমিতে আমন চাষে সুবিধা পাবেন কৃষক। সাধারণ পাটের আগা চিকন ও গোড়া মোটা হয়, নতুন এই জাতের আগা-গোড়া সমান। এর আঁশের উজ্জ্বলতা বেশি বলে জানান পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। পাটের এসব নতুন জাত থেকে উৎপাদিত পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার সুগম করতেও নেওয়া হয়েছে উদ্যোগ। আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাটের জীবনরহস্য ও নতুন জাতের মোট সাতটি মেধাস্বত্বের জন্য আবেদন করেছে বাংলাদেশ সরকার। এগুলো এখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট আশা করছে আগামী বছরের মধ্যেই তারা তা পাবে।

পাটের অন্য সুখবরও জানা গেছে এই বছর থেকেই। গত পাঁচ বছরে বহুমুখী পাটপণ্যের রপ্তানি দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশের পাটের তৈরি আধুনিক বিলাসসামগ্রী এখন ব্যবহৃত হচ্ছে ব্রিটিশ রাজপুত্র প্রিন্স চার্লসের বাসায়। স্পেন ও নেদারল্যান্ডসের রানির হাতে পৌঁছে গেছে পাটের তৈরি বাহারি ব্যাগ। ২০১১ সালে ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে ১৫ হাজার অংশগ্রহণকারীর হাতে যে আকর্ষণীয় ডিজাইনের পাটের ব্যাগ তুলে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোও গিয়েছিল বাংলাদেশ থেকে। পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে বিশ্বের বেশির ভাগ পরিবেশ-বিষয়ক সম্মেলনে পাটের ব্যাগ ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলোর বেশির ভাগই যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। আর এগুলো তৈরি করছেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা। প্রাথমিক নকশাও তাঁরাই করছেন।

একসময় দড়ি, চট, ছালা, বাজারের ব্যাগ বা বস্তার মতো সস্তা পণ্যের মধ্যে সীমিত ছিল পাটের ব্যবহার। সেই পাট এখন বিশ্বের নামীদামি গাড়ি তৈরির কোম্পানি বিএমডব্লিউর সর্বাধুনিক আই-থ্রি মডেলের ইলেকট্রিক গাড়ির ভেতরের বাক্স, বডি ও অন্যান্য উপাদান তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর তা রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। জার্মানির ফক্সওয়াগন, জাপানের নিশান ও টয়োটা গাড়ির বডি তৈরির কাঁচামাল হিসেবেও বাংলাদেশের পাটের সমাদর বাড়ছে। বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনে উৎসাহ দিতে ইতিমধ্যে জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) পুনর্গঠন করা হয়েছে। গত পাঁচ বছরে বহুমুখী পাটপণ্যের রপ্তানি দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ছে। ২০১২ সালে বাংলাদেশ থেকে বহুমুখী পাটপণ্য রপ্তানি হয়েছে ৩৭০ কোটি টাকার। ২০১৬ সালে তা বেড়ে ৭০০ কোটি টাকা হয়েছে। এ বছর তা ৮০০ কোটি টাকা ছুঁতে পারে বলে মনে করছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা। শুধু তা-ই নয়, সড়ক বা বাঁধ নির্মাণে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে রাবার ও পাটমিশ্রিত একধরনের কাপড়, যা ওই অবকাঠামোর স্থায়িত্বকাল বাড়াচ্ছে। জুটেক্স নামের ওই পণ্য দেশের বেশ কয়েকটি পাটকলে তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বিজ্ঞানীদের যৌথ উদ্যোগে পাট ও ভেড়ার লোম দিয়ে একধরনের কম্বল তৈরি করা হচ্ছে, যা শিগগিরই বাজারে আসার উপযোগী হবে বলে আশা করছেন সংস্থা দুটির বিজ্ঞানীরা।

পাটের আঁশ নিয়েই সন্তুষ্ট হয়ে বসে নেই বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। তাঁরা পাটের পাতার বহুবিধ ব্যবহার নিয়েও গবেষণা শুরু করেছেন। বিশ্বের প্রায় ২০টি আন্তর্জাতিক সংস্থার বিজ্ঞানীরা পাটের পাতার ক্যানসার প্রতিরোধক উপাদান নিয়ে গবেষণা করছেন। বাংলাদেশেও পাট থেকে চা তৈরির গবেষণা চলছে। একই সঙ্গে পাটের আঁশ দিয়ে ব্যাটারি, কেব্লের বিকল্পসহ নানা ধরনের পণ্য তৈরির গবেষণা করছেন দেশে-বিদেশে থাকা বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরা। অস্ট্রেলিয়ার উলংগং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা পাট থেকে তৈরি এসব পণ্য উদ্ভাবনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছেন।

পাট নিয়ে এত সব আয়োজনের মধ্যে আরেক সুসংবাদ হচ্ছে এই বছর থেকে ইউরোপের বাজারে কৃত্রিম আঁশের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আগামী বছর থেকে শপিং ব্যাগ থেকে শুরু করে পণ্যের মোড়ক সবকিছুতে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এর সুফল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের পাটচাষি ও পাটের শিল্প উদ্যোক্তারা পাবেন। সেই সুফল ঘরে তুলতে বাংলাদেশ প্রস্তুত হচ্ছে। সোনালি আঁশের সুদিন ফিরলে বাংলাদেশেরও দুর্দিন ঘুচবে।

‘দুই শতাংশ বাজার ধরতে পারলেও দেশে পাটের চেহারা বদলে যাবে’

রাশেদুল করিম
রাশেদুল করিম

বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনকারী সমিতির আহ্বায়ক রাশেদুল করিম। চলতি বছর পাট দিবসে শ্রেষ্ঠ বহুমুখী পাটপণ্য রপ্তানিকারক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার পেয়েছেন। দেশে পাটপণ্যের উৎপাদন ও আন্তর্জাতিক বাজার নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।

পাটের বিশ্ববাজার এখন কেমন? সেখানে বাংলাদেশের সম্ভাবনা কতটুকু?

রাশেদুল করিম: আশি ও নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত দেশের পাটের আঁশই ছিল মূল। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে পাট ইয়ার্ন ও সুতা তৈরির বিশ্ববাজার বড় হয়ে ওঠে। দেশেও বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা এ ক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগ করেন। তাঁরা দীর্ঘ সময় ধরে ভালোই মুনাফা করেছেন। নতুন নতুন কারখানা গড়ে তুলেছেন। মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে তাঁরা পণ্য সরবরাহ করে আসছিলেন। কিন্তু ওই অঞ্চলজুড়ে রাজনৈতিক সংকট ও অর্থনৈতিক মন্দার কারণে পাটের বাজার স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এরপর তুরস্কে একটি বড় বাজার তৈরি হচ্ছিল, কিন্তু সেখানেও রাজনৈতিক সংকটের কারণে বেসরকারি পাটজাত পণ্য উৎপাদনকারী কারখানাগুলো রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়েছে। ফলে সেগুলোর উৎপাদন কমে আসছে। প্রথাগত পাটপণ্যের বাজার সংকুচিত হয়েছে।

তাহলে এই খাতের কি কোনো ভবিষ্যৎ নেই?

রাশেদুল করিম: ভবিষ্যৎ আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা খারাপ মনে হতে পারে। কিন্তু আমি নতুন একধরনের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। চলতি বছর ইউরোপের বাজারে পলিথিনের ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আগামী বছর থেকে এই মহাদেশের ২৮টি দেশে একযোগে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে। এই দেশগুলোর শপিং মলগুলোতে আগে ফ্রি পলিথিন ব্যাগ দেওয়া হতো। এখন এর জন্য তারা অর্থ নিচ্ছে। পরিবেশবান্ধব তন্তু দিয়ে তৈরি ব্যাগ দিচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। সারা বিশ্বে প্রতিবছর ৫০০ বিলিয়ন পিস শপিং ব্যাগের চাহিদা আছে। এর বড় অংশ ইউরোপে। বিশ্বে প্রতিবছর ৫ শতাংশ করে পরিবেশবান্ধব ব্যাগের চাহিদা বাড়ছে। এই বাজারের ২ শতাংশ যদি আমরা ধরতে পারি, তাহলে দেশের পাট খাতের চেহারা বদলে যাবে।

এখন আমাদের পাট খাতের রপ্তানির চিত্র কেমন?

রাশেদুল করিম: অনেক বছর ধরেই আমরা বছরে ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকার পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করছি। বস্তা, রশি, চট ও কার্পেটের মতো প্রথাগত পাটপণ্যের রপ্তানি তেমন একটা বাড়ছে না। এগুলোর প্রতি টনের দাম সর্বোচ্চ ৬০০ ডলার। কিন্তু গত ছয় বছরে আমাদের বহুমুখী পাটপণ্যের রপ্তানি আয় দ্বিগুণ হয়েছে, এ বছর আমরা প্রায় ৭০০ কোটি টাকার বহুমুখী পাটপণ্য রপ্তানি করেছি। সামনের বছর আমরা ৮০০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছি। এইচএনএম, ওয়ালমার্টের মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড বাংলাদেশের পাট থেকে তৈরি কাপড় ও তৈজস সামগ্রী আমদানি শুরু করেছে। অনেক নতুন উদ্যোক্তা শত শত কোটি টাকা বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনে ব্যয় করছে। সরকার এই খাতকে সবুজ খাত হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছে। তবে আমাদের বেশ কিছু সমস্যাও আছে। সেগুলো দূর করতে পারলে এই খাত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে।

সমস্যাগুলো কী?

রাশেদুল করিম: আমরা যারা এই খাতে বিনিয়োগ করছি, তারা মূলত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে শুরু করেছি। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়েছি। এখনো আমাদের দামি পাটপণ্য উৎপাদনের কোনো ডিজাইন সেন্টার তৈরি হয়নি। ভারতে তিনটি সরকারি সংস্থা আছে, যারা পাটপণ্য নিয়ে গবেষণা ও নকশা তৈরি করে। ফলে আমাদের চেয়ে খারাপ মানের পাট উৎপাদন করেও বিশ্ববাজার তাদের দখলে। আর পৃথিবীর সর্বোচ্চ মানের পাট উৎপাদন করলেও বিশ্ববাজারের সম্ভাবনাকে আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। দেশের কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ খাত বিশেষ সুবিধা পায়। পাট কৃষিপণ্য হলেও পাটপণ্য কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ খাতের সুবিধা পায় না। বিশ্ববাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যেতে হলে দেশের ভেতরে প্রস্তুতিটা ভালোমতো নিতে হবে।

ইফতেখার মাহমুদ: সাংবাদিক