কেবল এগিয়ে যাওয়া

বিশ্বের অর্থনীতি িবষয়ক তাত্ত্বিকদের ভুল প্রমাণ করে গত ৪৬ বছর ধরে অর্থনীতির সব সূচকেই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। ছবি: প্রথম আলো
বিশ্বের অর্থনীতি িবষয়ক তাত্ত্বিকদের ভুল প্রমাণ করে গত ৪৬ বছর ধরে অর্থনীতির সব সূচকেই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। ছবি: প্রথম আলো

অর্থনীতিবিদ হিসেবে নরওয়ের জাস্ট ফাল্যান্ডের নামডাক আছে। অন্তত অর্থনীতিবিদেরা তাঁর কাজ সম্পর্কে ভালোই ধারণা রাখেন। বাংলাদেশের মানুষেরও তাঁর নামটি মনে রাখা উচিত। কেননা, এই দেশের মানুষের শক্তির ওপর সবচেয়ে কম আস্থা রাখে এমন কারও নাম বলতে গেলে জাস্ট ফাল্যান্ডের নামটি আগে আসার কথা। তিনি অবশ্য একা নন, সঙ্গী ছিলেন জে আর পার্কিনসন নামের আরেক অর্থনীতিবিদ। ১৯৭৬ সালে এই দুজন বাংলাদেশ দ্য টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট নামে একটি বই বের করেছিলেন লন্ডন থেকে। সেখানে তাঁরা বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে উন্নয়নের একটি পরীক্ষাক্ষেত্র। বাংলাদেশ যদি তার উন্নয়ন সমস্যার সমাধান করতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে, যেকোনো দেশই উন্নতি করতে পারবে। ’

স্বাধীনতার পাঁচ বছরের মাথায় বাংলাদেশ নিয়ে এ রকম এক ভাষ্য ছিল চরম হতাশাজনক। এই দুই অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে একটি ভালো অর্থনীতি গড়ে উঠতে পারবে, আলাদা হয়ে বাংলাদেশ টিকে থাকতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, এ দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সব সময়ে অর্থনৈতিক অগ্রগতির তুলনায় বেশি থাকবে, ফলে অর্থনীতিতে প্রকৃত আয় কখনো বাড়বে না। আর দেশটি জন্ম থেকেই সাহায্যনির্ভর, যত দিন যাবে, এই নির্ভরতা বাড়তে থাকবে।

বাংলাদেশের টিকে থাকা নিয়ে প্রকাশ্যে সন্দিহানদের তালিকায় হেনরি কিসিঞ্জারের নামও আছে। ১৯৭১ সালে হেনরি কিসিঞ্জারসহ মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা বাংলাদেশকে যে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বা ‘বাস্কেট কেস’ বলেছিলেন, এর পেছনে অর্থনীতির চেয়ে রাজনীতি ছিল বেশি। এরই ধারাবাহিকতায় জাস্ট ফাল্যান্ড ও জে আর পার্কিনসন যখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ২০৩ পৃষ্ঠার একটি বই লিখে ফেললেন, তখন তা যথেষ্ট গুরুত্বও পেয়ে গেল।

জাস্ট ফাল্যান্ড প্রয়াত হয়েছেন এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। সুতরাং বলাই যায়, ৪০ বছর আগেকার আশঙ্কার কথা যে মেলেনি, তা তিনি দেখে যেতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের পরীক্ষাক্ষেত্র তো নয়ই, বরং অনেকেই বলেন এর উল্টোটা। তাই তো ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল-এর শিরোনাম হয়, ‘বাংলাদেশ, নো মোর বাস্কেট কেস’। অর্থনীতিবিদেরাও এখন বাংলাদেশ নিয়ে লেখেন, ‘আ ডেভেলপমেন্ট মিরাকল’। এই তো গত ৭ সেপ্টেম্বর বিখ্যাত সাময়িকী ইকোনমিস্ট-এ বাংলাদেশ নিয়ে ছাপানো রিপোর্টের শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন পাকিস্তানের চেয়েও বেশি’। অনেক দেশের তুলনায় এখন বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেশি। কিন্তু পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাওয়া অবশ্যই একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ। কারণ, এই পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্তি পেতেই স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ। আর স্বাধীনতার লড়াইয়ে অন্যতম প্রধান যুক্তি ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি।

মাথাপিছু আয়ে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাওয়ার এই যাত্রাটি কিন্তু সহজ বা মসৃণ ছিল না। ৬০ ও ৭০ দশকে অর্থনীতি এগিয়েছে পা পা করে। অনেক সময়ে পিছিয়েও গেছে। অনেক বছরেই প্রকৃত আয়ে ছিল ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি। তথ্যপ্রযুক্তির এই সময়ে সেই ৬০-এর দশকের ‘পাকিস্তান ইকোনমিক সার্ভের’ অনেকগুলো সংখ্যা পাওয়া গেল। সে সময়ে অর্থনীতিতে যে প্রবৃদ্ধি ছিল না, এ জন্য রাজনৈতিক অস্থিরতাকেই মূলত দায়ী করা হয়। এ ছাড়া ১৯৬৫ সালের ইন্দো-পাকিস্তান যুদ্ধে প্রতিরক্ষা খাতে অতিরিক্ত ব্যয়ের কথাও বলা হয়েছে। আবার এই যুদ্ধের সময়েই তো এই অংশের মানুষ বুঝেছিল কতটা নিরাপত্তাহীন তারা। এ ছাড়া দুই অংশের মধ্যে সীমাহীন বৈষম্য তো ছিলই।

স্বাধীনতার ঠিক পরপরই দেশের অর্থনীতি কেমন ছিল? স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংক প্রথম রিপোর্ট করেছিল ১৯৭২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। সেখানে বলা হয়, ‘সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের উন্নয়ন সমস্যাটি অত্যন্ত জটিল। এখানকার মানুষ অত্যন্ত দরিদ্র, মাথাপিছু আয় ৫০ থেকে ৭০ ডলারের মধ্যে, যা গত ২০ বছরে বাড়েনি, জনসংখ্যার প্রবল আধিক্য এখানে, প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ৪০০ মানুষ বাস করে, তাদের জীবনের আয়ুষ্কাল অনেক কম, এখনো তা ৫০ বছরের নিচে, বেকারত্বের হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে এবং জনসংখ্যার বড় অংশই অশিক্ষিত।’ এ থেকে বলা যায়, বিশ্বব্যাংকও বাংলাদেশ নিয়ে খুব আশাবাদী ছিল না।

এবার এগিয়ে যাওয়ার গল্পটা বলি। ১৯৭২-৭৩ সালের মূল্যমানে ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশে মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল ৭৪৪ টাকা। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত মাথাপিছু আয় এক টাকাও বাড়েনি। বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় বাড়তে শুরু করে ১৯৮৩ সাল থেকে, যদিও বৃদ্ধির হার ছিল সামান্য। এরপর ধীরে ধীরে তা বেড়েছে। এর মধ্যে গত প্রায় এক দশকে, অর্থাৎ ২০০৯-এর পর থেকে মাথাপিছু আয় দ্রুত বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ৭৪৪ টাকা দিয়ে শুরু করার ৪৫ বছর পর তা অনেক বেড়ে এখন হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৯৩১ টাকা। অর্থনীতিবিদ রুশিদান ইসলাম রহমান এ কারণেই লিখেছেন, ‘যদিও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ নৈর্ব্যক্তিকভাবেই করা বাঞ্ছনীয়, তবু যখন ১৯৬৯-৭০ বা ১৯৭১-৭৩ সালের সঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশের তুলনা করি, তখন কিছুটা আবেগপ্রবণ হলে বোধ হয় দোষ দেওয়া যায় না। ’

মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাওয়ার প্রথম স্বীকৃতি আমরা পাই ২০১৫ সালে। ওই বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশ স্বল্প আয়ের দেশ থেকে এক ধাপ এগিয়ে নিম্নমধ্যম আয়ের তালিকায় ঢুকে পড়ে। মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে কোন দেশ নিম্ন আয়ের, আর কোন কোন দেশ উচ্চ বা মধ্যম আয়ের, তা নির্ধারণ করে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের পরিমাপ অনুযায়ী, ১ হাজার ৪৫ ডলার থেকে ১২ হাজার ৭৩৫ ডলার পর্যন্ত মাথাপিছু জাতীয় আয় হলে একটি দেশ মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় যাবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় (জিএনআই) এখন ১ হাজার ৩১৪ ডলার। তবে বাংলাদেশ ১৯৭৫ সাল থেকে এখনো জাতিসংঘের তালিকায় স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি। এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটাতে হলে কেবল মাথাপিছু আয় বাড়লেই হয় না। এর সঙ্গে সামষ্টিক অর্থনীতির ধারাবাহিক স্থিতিশীলতা, অর্থনীতির ভঙ্গুরতা এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো সামাজিক সূচকেরও উন্নতির প্রয়োজন হয়।

এখানেই সেই পুরোনো বিতর্কটা আবার উঠে আসে। অর্থাৎ জাতীয় আয় বাড়লেই কি তাকে আমরা উন্নত বলব? একটা কাজ করা যাক। একটু পরে যে রিকশায় উঠবেন, কিংবা অফিস থেকে ফেরার পথে রাস্তার সবজিওয়ালাকে অথবা বাড়ির দারোয়ানকে বলে দেখেন, তাঁরও মাথাপিছু আয় যে ১ লাখ ২০ হাজার ৯৩১ টাকা, এ কথা সে জানে কি না? মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিকে উন্নয়নের পরিমাপক ভাবার বিপদ এখানেই। ভারতের অর্থনীতিবিদ সুগত মারজিৎ এই ধারণার সমালোচনা করে লিখেছেন, ‘বাবার সাইকেল ছিল না, ছেলে বাইক চড়ে, এটাই উন্নয়ন।’ আদতে মাথাপিছু আয় বাড়াতে গিয়ে বৈষম্য বাড়ার অনেক উদাহরণ সেই ৭০-এর দশকেই দেশে দেশে দেখা গেছে। তাই কেবল আয় বৃদ্ধিকে এখন উন্নতির একমাত্র উপায় মনে করা হয় না। যেমন সরকারি হিসাবেই বাংলাদেশে মোট জাতীয় আয়ের ৩৮ শতাংশই আয় করেন শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনী আর মাত্র ১ শতাংশ করে সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষ। সব মিলিয়ে এখনো দেশে ৩ কোটি ৯৩ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।

নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এ কারণেই বলেন, ‘সম্ভবত সাবেকি উন্নয়নতত্ত্বের প্রধান তত্ত্বগত ত্রুটি এই যে এ তত্ত্বে জোর দেওয়া হয়েছে জাতীয় উৎপাদন, মোট আয় এবং বিশেষ বিশেষ পণ্যের মোট সরবরাহের ওপর। মানুষের স্বত্বাধিকার এবং সেই স্বত্বাধিকার থেকে পাওয়া ক্ষমতার দিকে নজর দেওয়া হয়নি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের চরম লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষের সক্ষমতা সৃষ্টি। মানুষ কী করতে পারছে, কী করতে পারছে না, সেটাই উন্নয়নতত্ত্বের আলোচ্য হওয়ার কথা। মানুষটি কি দীর্ঘ জীবন লাভ করছে? অকালমৃত্যুকে জয় করতে পারছে? তার কি যথেষ্ট পুষ্টির ব্যবস্থা হয়েছে? সে কি লিখতে, পড়তে, পরস্পর চিন্তার আদান-প্রদান করতে শিখেছে? সাহিত্যচর্চায়, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় পারঙ্গম হয়েছে? উন্নয়ন-তত্ত্ববিদদের কাছে এগুলোই হওয়া উচিত ছিল আসল প্রশ্ন। ’

তাহলে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হওয়া, এলডিসি থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি—এসব কিছুই না? জমিদারি দেখাশোনার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নওগাঁর পতিসরে এসেছিলেন ১৮৯১ সালে। এর এক বছর আগে এসেছিলেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে। এখানে এসেই রবীন্দ্রনাথ প্রথম নিজের চোখে চরম দারিদ্র্য দেখেছিলেন। বলা হয়, এরপরই রবীন্দ্রনাথের কবিতায় একধরনের পরিবর্তন এসেছিল। পতিসরে বসে লেখা অনেক কবিতার মধ্যে একটি হচ্ছে ‘এবার ফিরাও মোরে’। কবি লিখেছেন, ‘বড়ো দুঃখ, বড়ো ব্যথা—সম্মুখেতে কষ্টের সংসার/ বড়োই দরিদ্র, শূন্য, বড়ো ক্ষুদ্র, বদ্ধ, অন্ধকার।’

ঠিক স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অবস্থা ছিল আসলে এ রকমই। ভরসা ছিল কেবল মানুষ। তবে প্রয়োজন ছিল সরকারের সমর্থন, অনুকূল পরিবেশ, কাজ করতে দেওয়ার স্বাধীনতা। রবীন্দ্রনাথই একই কবিতায় যেমনটি বলেছেন, ‘এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে/ দিতে হবে ভাষা; এই-সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে/ ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা; ডাকিয়া বলিতে হবে—/ মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে/ যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা-চেয়ে,/ যখনি জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে।’

সব আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশে এখন জনসংখ্যা বাড়ার চেয়ে আয় বাড়ার হার বেশি। যে জনসংখ্যাকে দায় মনে করা হয়েছিল, তারাই এখন সম্পদ। মধ্যবিত্তের উত্থানে বাংলাদেশকে মনে করা হচ্ছে বড় বাজার। সামাজিক সূচকেও এগিয়ে বাংলাদেশ। উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা দেশের মানুষকে আজকের এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে। তবে অমর্ত্য সেন অনেক আগেই সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আয়বৃদ্ধি চরম লক্ষ্য নয়, লক্ষ্যে পৌঁছানোর একটি উপায়মাত্র।’ সুতরাং এই যে আয় বৃদ্ধি হচ্ছে, এখন প্রয়োজন উন্নয়নের পরের স্তরে দেশকে নিয়ে যাওয়া। আর এ জন্য—

‘অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু,

চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু,

সাহসবিস্তৃত বক্ষপট। ’

(এবার ফিরাও মোরে)

শওকত হোসেন: সাংবাদিক