মহাকাশ থেকে হরিশপুর

২০০২ সালে সৌরিবদ্যুৎ প্যানেল প্রকল্প চালুর পর প্রত্যন্ত এলাকার ঘরে ঘরে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ছবি: প্রথম আলো
২০০২ সালে সৌরিবদ্যুৎ প্যানেল প্রকল্প চালুর পর প্রত্যন্ত এলাকার ঘরে ঘরে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান প্রতিবন্ধক হচ্ছে প্রাথমিক জ্বালানির অভাব। দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের নতুন কোনো ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়নি এবং বিদ্যমান মজুতও ক্রমশ শেষ হয়ে আসছে। এমনকি প্রাকৃতিক গ্যাসের বর্তমান জোগান চাহিদার তুলনায় অনেক কম। আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ব্যবহার করে বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদন করা হলে গ্রাহক পর্যায়ে তার যে উচ্চমূল্য দাঁড়াবে, তা নিয়ে ব্যবসায়ীসহ সবাই উদ্বিগ্ন। উপরন্তু কয়লানীতির অভাবে দেশে পাঁচটি খনির মধ্যে মাত্র একটি থেকে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। কয়লা আমদানির জন্য পর্যাপ্ত কাঠামোগত সুবিধা দেশে নেই।

এ পরিস্থিতিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও শক্তি একটি ভালো সমাধান হতে পারে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎসগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া জল ও বায়ুবিদ্যুৎ এবং বায়োগ্যাসের সীমিত সম্ভাবনা আছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের আরেকটি সুবিধা হলো এটি পরিবেশবান্ধব। বাংলাদেশে বিগত দুই দশকে সৌরবিদ্যুৎ কর্মসূচির, বিশেষত সোলার হোম সিস্টেমের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা আমাদের প্রাথমিক জ্বালানি সমস্যার একটি সমাধানে উপনীত হতে পারি।

১৮৩৯ সালে আলেক্সান্দ্রে বেকিউরেল সৌরবিদ্যুতের সম্ভাবনা আবিষ্কার করলেও এর প্রায়োগিক ব্যবহার শুরু হয় ১৯৫৮ সালে বেলল্যাব কর্তৃক মহাকাশ কার্যক্রমে। এর উদ্দেশ্য ছিল রকেটের জ্বালানি প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে এর ওজন কমানো। মহাকাশ থেকে মর্ত্যে এর ব্যবহার শুরু হয় সত্তরের দশকে ইয়েপ্পি (Yippie) প্রজন্মের নগরজীবন প্রত্যাখ্যান ও বিকল্প জীবনধারা অনুসরণ থেকে। তারা শহর থেকে দূরে পাহাড় ও অরণ্যে বসবাস শুরু করে এবং সেখানে সোলার হোম সিস্টেম ব্যবহার করতে থাকে। মহাকাশ থেকে ইয়েপ্পিদের হাত হয়ে বাংলাদেশের সন্দ্বীপের প্রত্যন্ত হিরশপুরে সোলার হোম সিস্টেম এখন ছড়িয়ে পড়েছে।

২০০২ সালে সন্দ্বীপ থেকে যাত্রা শুরু করে দেশে এ পর্যন্ত ৪৫ লক্ষাধিক বাড়ি ও দোকানপাটে সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে, ফলে দুই কোটির বেশি মানুষ উপকৃত হচ্ছে। এটা এক বিরাট সাফল্য।

তবে সাফল্যের হিসাবটা যত সোজা, যাত্রাটা তত সহজ ছিল না। ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড বা ইডকলে প্রকল্পটি শুরু করতে গিয়ে আমাদের অনেক বাধাবিপত্তির মুখে পড়তে হয়েছে। ইডকলের ব্যবস্থাপনা পর্ষদ প্রথমেই প্রশ্ন তুলল, বড় অবকাঠামোর প্রকল্প অর্থায়নের জন্য তৈরি প্রতিষ্ঠান ইডকল কেন এত ছোট প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে? তাদের বোঝানো হয় যে একটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র আর সোলার হোম সিস্টেমের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই, দুটিই বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে। তা ছাড়া সোলার হোম সিস্টেমের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থার প্রয়োজন হয় না।

পরবর্তী সময়ে প্রকল্পটির অর্থায়ন বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমাদের প্রকল্প বাস্তবায়ন বিষয়ে প্রথমদিকে নানান মতানৈক্য ঘটে। যেমন বিশ্বব্যাংকের বক্তব্য ছিল যে ইডকলকে সোলার হোম সিস্টেমের যাবতীয় সামগ্রী কিনতে হবে এবং গ্রামীণ শক্তি ও ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠিত কোনো সংস্থাকে সোলার হোম সিস্টেম প্রসারের সঙ্গে জড়িত করা যাবে না। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক নিয়োজিত ইউরোপীয় পরামর্শক তাঁর দেশের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জন্য অবাস্তব পরামর্শ দিতে থাকেন। বিশ্বব্যাংককে আমরা বোঝাতে সক্ষম হই যে ইডকলের কেন্দ্রীভূত ক্রয়ব্যবস্থায় দুর্নীতির সম্ভাবনা থাকবে; সুপ্রতিষ্ঠিত এনজিও বা ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থা ছাড়া কেবল নতুন সহযোগী সংস্থা দিয়ে এ কাজে বেশি দূর এগোনো যাবে না। বিশ্বব্যাংক আমাদের পরামর্শ দুটি শর্তে গ্রহণ করে। প্রথমত, ভবিষ্যতে তারা সোলার হোম সিস্টেমের মূল্য ও প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করবে এবং আমরা ব্যর্থ হলে তারা তাদের পরামর্শ ও পরামর্শক পুনর্বহাল করবে। সুখের বিষয় যে এ দুটি শর্তেই আমরা উতরে যাই।

ইডকলে আমরা বিশ্বব্যাংকের ৫০ হাজার সিস্টেম স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত সময়ের তিন বছর আগেই অর্জন করি এবং কয়েক মিলিয়ন ডলার কম ব্যয়ে এগুলো স্থাপনে সক্ষম হই। এ উপলক্ষে এক পত্রে বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রফুল সি. প্যাটেল আমাকে লেখেন, ‘সময়সীমার তিন বছর আগেই প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বেশ বিরল। ২০০২ সালে যখন গ্রামীণ বিদ্যুতায়ন ও নবায়নযোগ্য শক্তির উন্নয়ন প্রকল্পটির সূচনা করা হচ্ছিল, তখন পাঁচ বছরের মধ্যে (২০০৩-০৮) ৫০ হাজার সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনের ধারণাটি বেশ উচ্চাভিলাষী মনে হয়েছিল। তবে আমরা নিজেদের সর্বোত্তম উপায়ে ভুল প্রমাণ করতে পেরেছি। একটি সুস্থ প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মানুষের দ্বারা পরিবর্তন আনার বিষয়ে এই প্রকল্প একটি যুগান্তকারী উদাহরণ।’

এখন সারা বিশ্বে বাংলাদেশের সোলার হোম সিস্টেম কার্যক্রম সবচেয়ে দ্রুত ও সফল মডেল হিসেবে বিবেচিত।

প্রকল্পের প্রথম দিকে আমরা সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গ্রামের বাজারে প্রদর্শনী দিতাম। গ্রামের মানুষ অবাক হতো, ভাবত আমরা বোধ হয় কোনো জাদু দেখাচ্ছি। এ সময় আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রায় প্রতি সপ্তাহে গ্রামে বাড়িতে-বাড়িতে দোকানে-দোকানে গিয়ে গ্রাহকদের মন্তব্য জানতে চাইতাম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখেছি, পরিবারের নারীরাই বাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ আনতে উৎসাহী ছিলেন। সৌরবিদ্যুৎ কেন নিয়েছেন, তা জানতে চাইলে তাঁরা আমাকে বলেন, এতে ছেলেমেয়ের পড়াশোনার সুবিধা হয়েছে।

ইডকলের কর্মসূচির প্রথম দিকে সৌরবিদ্যুৎকে সহজলভ্য করার জন্য স্বল্প সুদে ঋণ ও ভতু‌র্কির ব্যবস্থা ছিল। প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়নের ফলে আমাদের ভতু‌র্কির টাকা শেষ হয়ে যায় এবং প্রকল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় ডিসেম্বর মাসে আমাকে বার্লিনে একটি সেমিনারে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ডিসেম্বর মাসে ইউরোপে প্রচণ্ড শীতের কারণে আমি যেতে আগ্রহী ছিলাম না। তবে এই শর্তে সম্মত হই যে সেখানে আমাকে বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ কর্মসূচির বিষয়ে একটি উপস্থাপনার সুযোগ দেওয়া হবে। সেমিনারের কর্মসূচি ইতিমধ্যে চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ায় আমাকে মূল সেমিনারের পরিবর্তে মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে খানিকটা সময় দেওয়া হয়। কিন্তু সেমিনারে যেটা সচরাচর ঘটে, আলোচনা দীর্ঘায়িত হয়ে মধ্যাহ্নভোজের বিরতির সময় কমে যায়। আমি আমার প্রায় ১০ মিনিটের উপস্থাপনা শুরু করার ৩ মিনিটের মাথায় সভাপতি মহোদয় আমাকে থামতে বলেন, যাতে সবাই মূল অধিবেশনে ফিরে যেতে পারে। আমি অত্যন্ত মর্মাহত হই। অনেক যত্নে ভিডিওসহ উপস্থাপনাটি তৈরি করেছিলাম। আশা ছিল এটা দেখিয়ে ইউরোপীয় কোনো দাতা সংস্থাকে ভতু‌র্কির টাকার জন্য রাজি করাতে পারব।

ভগ্নমনোরথ হয়ে বাথরুমে যাই। সেখানে একজন জার্মান ভদ্রলোক আমার কাঁধে হাত রেখে বলেন, ‘আমি দুঃখিত। তোমাকে এভাবে মাঝপথে থামানো সভাপতির ঠিক হয়নি।’ পরে দিনের শেষে পুরো ভিডিওটি দেখে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের কত টাকা দরকার?’ আমি তাঁকে বললাম কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হলে আমাদের প্রায় ১৫ মিলিয়ন ডলার দরকার। তিনি বললেন, ‘তোমাকে কোনো কথা দিচ্ছি না, তবে আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করব।’ পরবর্তী সময়ে সেই ভদ্রলোকের প্রচেষ্টায় আমরা কেএফডব্লি­উয়ের মাধ্যমে ভতু‌র্কির জন্য ১৫ মিলিয়ন ডলার পাই।

সোলার হোম সিস্টেম কর্মসূচি এত দ্রুত বাস্তবায়নের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথম কারণটি হলো সৌর প্যানেলের ক্রমহ্রাসমান দাম। আমরা যখন কর্মসূচি শুরু করি, তখন প্রতি ওয়াটপিক সোলার প্যানেলের দাম ছিল প্রায় ৫ ডলার। তখন প্রতি ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ ছিল ৮০ টাকার ওপরে। এখন প্যানেলের দাম ৩৫-৪৫ সেন্ট এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ ১৫-১৬ টাকায় নেমে এসেছে। ভবিষ্যতে যা আরও কমবে বলে আশা করা যায়।

সৌরবিদ্যুতের সাফল্যের দ্বিতীয় কারণটি হলো ওই সময় বিশ্বব্যাপী কেরোসিন তেলের দাম হুহু করে বাড়তে থাকা। ফলে গ্রামে হারিকেন ও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের ব্যয় প্রায় কাছাকাছি চলে আসে। সবশেষে স্বল্প বিদ্যুৎ খরচের এলইডি বাতি আবিষ্কারের ফলে একটি ছোট সিস্টেম ব্যবহার করে অনেক বেশি আলো পাওয়া সম্ভব হয়। আগে যেখানে একটি ঘর আলো করতে ১০-১১ ওয়াটের বাতি লাগত, এখন ২-৩ ওয়াটের বাতি থেকেই একই পরিমাণ আলো পাওয়া সম্ভব হচ্ছে।

এই একটি মাত্র কর্মসূচির ক্ষেত্রেই আমরা রাজনৈতিক মতৈক্য লক্ষ করেছি। বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী কেন্দ্র থেকে ২০০৫ সালে তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ৫০ হাজার সোলার হোম সিস্টেমের উদ্বোধন করেন এবং ২০১২ সালে সন্দ্বীপে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ লাখ সোলার হোম সিস্টেমের উদ্বোধন করেন।

সোলার হোম সিস্টেমের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। যেমন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এর ব্যবহার বেশ সীমিত। তবে আমরা একটি প্রজন্মকে হারিকেন ও কুপি বাতির অন্ধকার জীবন থেকে মুক্তি দিতে সমর্থ হয়েছি, এটাই বা কম কিসে?

আশার কথা হলো, এখন সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে সেচ ও ক্ষুদ্র কলকারখানা চালানো হচ্ছে এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্নভাবে এর ব্যবহার হচ্ছে। এমনকি অতি সম্প্রতি জাতীয় গ্রিডেও সৌরবিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।

আমরা সেদিন প্রায় না বুঝে বা অল্প বুঝে একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ওপর বাজি ধরেছিলাম। তারা সেই প্রযুক্তি গ্রহণ, ব্যবহার ও প্রসার ঘটিয়ে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।

এম ফাওজুল কবির খান: সাবেক বিদ্যুৎসচিব ও প্রতিষ্ঠাতা প্রধান নির্বাহী, ইডকল