নিজামী-বাবরসহ ১৪ জনের ফাঁসি

দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় ঘোষণার আগে গতকাল বেলা সোয়া ১১টায় আদালত প্রাঙ্গণে প্রিজনভ্যান থেকে নামছেন সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর । ছবি: সৌরভ দাশ
দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় ঘোষণার আগে গতকাল বেলা সোয়া ১১টায় আদালত প্রাঙ্গণে প্রিজনভ্যান থেকে নামছেন সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর । ছবি: সৌরভ দাশ

১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলার মধ্যে একটিতে সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়া এবং দুটি গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ১৪ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
চোরাচালানের মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ৫২ আসামির মধ্যে ১৪ জনকে এই সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়। বিশেষ ক্ষমতা আইনে করা এই মামলায় একই সঙ্গে এঁদের পাঁচ লাখ টাকা করে জরিমানাও করা হয়। আর অস্ত্র আইনে করা মামলায় এই ১৪ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এই মামলায় আসামি ছিলেন ৫০ জন।
চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক এস এম মজিবুর রহমান গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এ রায় ঘোষণা করেন।
অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত মামলার ৩৮ আসামিকে বেকসুর খালাস দেন। এঁদের বেশির ভাগই চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) ঘাটের শ্রমিক।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল সিইউএফএল ঘাট থেকে আটক করা হয় ১০ ট্রাকভর্তি অস্ত্রের চালান। এ নিয়ে কর্ণফুলী থানায় ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন ও ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে চোরাচালানের অভিযোগ এনে দুটি মামলা হয়। সিআইডি পুলিশ দুটি মামলা একসঙ্গে তদন্ত করে। এর বিচারও একসঙ্গে শুরু হয়। গতকাল বিচারক দুটি মামলার রায় একসঙ্গে ঘোষণা করেন।
আদালতে রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ মামলা। এ মামলায় রাষ্ট্রের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা সাক্ষ্য দিয়েছেন। এমনকি প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (এনএসআই) কর্মকর্তারা সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ ধরনের ঘটনা বিশ্বের আর কোথাও ঘটেছে কি না সন্দেহ। বাবর, নিজামী ও পরেশ বড়ুয়া ছাড়া ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত অন্য আসামিরা হলেন ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রহিম, পরিচালক উইং কমান্ডার (অব.) সাহাব উদ্দিন আহাম্মদ, উপপরিচালক মেজর (অব.) লিয়াকত হোসেন, এনএসআইয়ের মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান, সিইউএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন উদ্দিন তালুকদার, মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কে এম এনামুল হক, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব নুরুল আমিন, অস্ত্র বহনকারী ট্রলারের মালিক হাজি সোবহান, চোরাকারবারি হাফিজুর রহমান এবং অস্ত্র খালাসের জন্য শ্রমিক সরবরাহকারী দ্বীন মোহাম্মদ। এঁদের মধ্যে পরেশ বড়ুয়া ও নুরুল আমিন পলাতক। আটক ১২ জনকে রাতেই কারাগারে ফাঁসির সেলে নিয়ে রাখা হয়েছে।
রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে গতকাল ভোর থেকেই আদালতের প্রবেশমুখে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। কড়া নিরাপত্তা চোখে পড়ে সর্বত্র। আদালতকক্ষে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না।
সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে নিরাপত্তা পরিবেষ্টিত হয়ে আদালতে আসেন বিচারক এস এম মজিবুর রহমান। ১১টা ১৫ মিনিটে আসামি বাবর, নিজামীসহ সব আসামিকে আদালতে আনা হয়। আদালতে এসে বাবর ও নিজামী এজলাসে আসামির কাঠগড়ায় না ঢুকে প্রথমে আইনজীবীদের জন্য রাখা চেয়ারে কিছুক্ষণ বসেন। পরে তাঁদের কাঠগড়ায় নেওয়া হয়।
দুপুর সোয়া ১২টার পর বিচারক এজলাসে আসেন। রায় ঘোষণার আগে একটি কাগজ নিয়ে তিনি মামলার আসামি আবদুস সোবহান হাজির আছেন কি না জানতে চান। কিন্তু এজলাসে আইনজীবী ও গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড় থাকায় বিচারকের সামনে আসতে পারেননি আবদুস সোবহান। তাঁর আইনজীবী উপস্থিতির কথা জানান।

রায় ঘোষণার আগে বেলা সোয়া ১১টায় আদালত প্রাঙ্গণে প্রিজনভ্যান থেকে নামছেন ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার (সামনে) ও এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহীম । ছবি: প্রথম আলো
রায় ঘোষণার আগে বেলা সোয়া ১১টায় আদালত প্রাঙ্গণে প্রিজনভ্যান থেকে নামছেন ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার (সামনে) ও এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহীম । ছবি: প্রথম আলো

বিচারক তাঁর আদেশে বলেন, মামলার আসামিরা পরস্পরের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আদালত গায়ের জোরে কিছু করছেন না। বিচারক উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘তৎকালীন শিল্পসচিব ড. শোয়েব আহমদ জামায়াতের নেতা মতিউর রহমান নিজামীকে ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন।’ প্রায় ২৪ মিনিট রায়ের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন তিনি। এরপর বিচারক সাজাপ্রাপ্ত ১৪ আসামির নাম ঘোষণা করে বলেন, ‘পৃথক দুই মামলায় যাবজ্জীবন ও ফাঁসির আদেশ দেওয়া হলো। দুটি সাজা একসঙ্গে চলবে এবং আসামিদের হাজতবাস সাজা থেকে বাদ যাবে।’ এরপর তিনি এজলাস ত্যাগ করেন।
রায় ঘোষণা শেষ হতে না-হতেই সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর কাঠগড়া থেকে চিৎকার করতে থাকেন। আসামি কে এম এনামুল হক কাঠগড়ায় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান। পুলিশ সদস্যরা তাঁকে ধরাধরি করে নিয়ে যান।
রায়ের পর বিএনপি ও জামায়াতপন্থী আইনজীবীরা আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তাঁরা ‘এ রায় মানি না, ভারতের দেওয়া রায় মানি না’ বলে স্লোগান দেন।
আলোচিত এই মামলার রায় শোনার জন্য আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত ছিলেন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ অন্য নেতারা। জোট সরকারের সময় এই অস্ত্র আটক হয় বলে তখন সরকারের মন্ত্রীরা বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য এই অস্ত্র এনেছে।
রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি কামাল উদ্দিন আহাম্মদ বলেন, এটি অত্যন্ত স্পর্শকতার ও নজিরবিহীন ঘটনা। আদালতই তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেছেন, এ ধরনের ঘটনা পৃথিবীর আর কোথাও ঘটেছে কি না সন্দেহ!
আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. কামরুল ইসলাম সাজ্জাদ রায়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এটি হাই প্রোফাইল পলিটিক্যাল জাজমেন্ট (উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক রায়)। রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ।’
মামলার বাদী আহাদুর রহমান রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে জানান, দীর্ঘ সাড়ে নয় বছর পর অপরাধের সাজা হয়েছে। একই মত প্রকাশ করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মনিরুজ্জামান চৌধুরী বলেন, অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় আদালত তাঁদের সাজা দিয়েছেন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, অস্ত্র আটক ও চোরাচালান মামলায় ২০০৪ সালের ১১ জুন প্রথম দফা ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে সিআইডি। এরপর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ২৫ আগস্ট সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ মামলা দুটির অধিকতর তদন্ত শুরু হয়। তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ২৬ জুন নতুন করে বাবর, নিজামীসহ ১১ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। অস্ত্র আটক মামলায় ৫০ জন এবং চোরাচালান আইনে ৫২ জনকে আসামি করা হয়।
২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। অস্ত্র আটক মামলায় ৫৬ এবং চোরাচালান আইনে ৫৩ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন।
গতকাল এক বিবৃতিতে জামায়াত বলেছে, তারা এ রায়ে ব্যথিত ও বিস্মিত। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।
নিজামী ও বাবর দুজনই এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন।
বিবিসিকে উলফা: উলফার যে অংশটি ভারত সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, সেই অংশের চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়া ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলার রায়ের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে সংগঠনটির পররাষ্ট্রসচিব শশধর চৌধুরী বিবিসিকে বলেছেন, পরেশ বড়ুয়া পৃথক সংগঠন করেন। এ বিষয়ে তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানানোর কিছু নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংগঠনের কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, পরেশ বড়ুয়া ছাড়া যেহেতু দলের আর কারও শাস্তি হয়নি, তাই সংগঠন (উলফা) যে অস্ত্রোপচারে জড়িত নয়, এটা প্রমাণিত হয়েছে।

সাহাব উদ্দিন আহাম্মদ,লিয়াকত হোসেন, আকবর হোসেন খান, মহসিন উদ্দিন তালুকদার, কে এম এনামুল হক, হাজী সোবহান, হাফিজুর রহমান, দ্বীন মোহাম্মদ
সাহাব উদ্দিন আহাম্মদ,লিয়াকত হোসেন, আকবর হোসেন খান, মহসিন উদ্দিন তালুকদার, কে এম এনামুল হক, হাজী সোবহান, হাফিজুর রহমান, দ্বীন মোহাম্মদ