ক্ষতবিক্ষত বুক থেকেই নতুন ফসলের উত্থান

আগে ফসল বলতে ছিল আমন ধান। সিডরের পর খুলনার দাকোপ উপজেলার কৃষক শস্য বহুমুখীকরণে ঝুঁকেছেন। উপজেলার বাজুয়া এলাকায় তরমুজখেতের পরিচর্যার ছবিটি গত ২৮ এপ্রিল তোলা l সাদ্দাম হোসেন
আগে ফসল বলতে ছিল আমন ধান। সিডরের পর খুলনার দাকোপ উপজেলার কৃষক শস্য বহুমুখীকরণে ঝুঁকেছেন। উপজেলার বাজুয়া এলাকায় তরমুজখেতের পরিচর্যার ছবিটি গত ২৮ এপ্রিল তোলা l সাদ্দাম হোসেন

সময়টা নভেম্বরের মাঝামাঝি। মাঠজুড়ে আমন ধান। সবুজ ধানগাছের বুক চিরে বেরিয়েছে ছড়া। ছড়াগুলো বড় হচ্ছিল, আর বড় হচ্ছিল কৃষকের স্বপ্ন। আর মাত্র কয়েকটা দিন পর সোনালি ফসল ঘরে তোলার সময়। এমন স্বপ্নে বিভোর সময়ে উপকূলে দানবীয় শক্তি নিয়ে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় সিডর।

খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপে সিডরে অনেক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হলেও প্রাণহানি ঘটেনি। তবে সিডর ভেঙে দিয়েছিল কৃষকের সুখস্বপ্ন। দিনটি ছিল ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর। আজ বুধবার পূর্ণ হবে এর ১০ বছর।

সিডরের পর ওই অঞ্চলের একমাত্র ফসল আমনের উৎপাদন অর্ধেকেরও কমে নেমে আসে। কিন্তু প্রকৃতির নির্মম ছোবলের পরও বেঁচে থাকার দুরূহ সংগ্রামে লিপ্ত মানুষগুলো স্বপ্ন দেখেছিলেন উঠে দাঁড়ানোর। একফসলি জমিতে নতুন ফসল করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাঁরা। সেই উদ্যোগ মাঝেমধ্যে বাধাগ্রস্ত হলেও বর্তমানে কৃষির এক উর্বর ভূমি হয়ে উঠেছে এই অঞ্চল। এখন এ অঞ্চলের জমিতে বছরে কয়েক ফসল তুলে আনেন কৃষকেরা।

দাকোপের কালিকাবাটি গ্রামের কৃষক চিত্তরঞ্জন মণ্ডলের সঙ্গে কথা হয় গত শনিবার। তিনি বলেন, ‘২০০৭ সালে ১০ বিঘা জমিতে আমন লাগিয়েছিলাম। গাছের অবস্থা খুব ভালো ছিল। তবে সিডরে ধানগাছের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এর ওপর চরমভাবে বেড়ে গিয়েছিল পোকার আক্রমণ। অন্য বছর যেখানে বিঘায় ১৫ থেকে ১৮ মণ করে ধান পেতাম সেবার পেলাম মাত্র ৫৫ মণ। সারা বছর কীভাবে চলবে সে চিন্তা তখন পেয়ে বসে। এরপর এলাকার কমবেশি সবাই বোরোর আবাদ করেছিলাম। ধান খুব বেশি না পেলেও খোরাক নিয়ে আর চিন্তা করা লাগেনি।’

বিভিন্ন গ্রামের অন্তত ৩০ জন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দাকোপের অধিকাংশ কৃষিজমি একসময় একফসলি ছিল। ১৯৯৫ সালের দিকে কিছু জমিতে তরমুজের চাষ করা হলেও পরিমাণে তা ছিল খুবই কম। কিন্তু সিডরে এলাকার কৃষক বড় ধাক্কা খান। এরপর তাঁরা কৃষিতে বেশি মাত্রায় ঝুঁকে পড়েন। আয় বাড়াতে এলাকায় তরমুজ চাষ বাড়তে থাকে। পরিসর বাড়তে থাকে সবজি আবাদের। আর কম পরিসরে শুরু হয় বোরো চাষ। এরপর আবার আইলার আঘাতে টালমাটাল হয় কৃষি খাত। তবে টানা দুটি মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর এলাকার কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, গত মৌসুমে দাকোপে ২৫ হেক্টর জমিতে বোরো, দেড় হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ, ২০ হেক্টর জমিতে আউশ ও ১৯ হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষ করা হয়। দাকোপের সবজি এখন জেলার বাইরেও যাচ্ছে।

জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মোসাদ্দেক হোসেন গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, আমননির্ভর দাকোপে এখন নানা ফসলের শস্যভান্ডারে পরিণত হয়েছে। মূলত সিডরের পর থেকে বোরো চাষ শুরু হয়। এরপর থেকে তরমুজের চাষও বেড়েছে। এখন তো আইলাবিধ্বস্ত সুতারখালী ও কামারখোলাতেও বোরো, তরমুজ, আমনসহ নানা ফসলের সমারোহ। আর এখন দাকোপে আমন ধানের চাষ ও উৎপাদন বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।