শিশুদের জন্য 'শিল্পাঞ্জলি'

নড়াইলে শিল্পাঞ্জলি ভবনে ছবি আঁকছে খুদে শিল্পীরা l প্রথম আলো
নড়াইলে শিল্পাঞ্জলি ভবনে ছবি আঁকছে খুদে শিল্পীরা l প্রথম আলো

নড়াইল শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে পৌরসভার দক্ষিণ কুড়িগ্রামের ‘শিল্পাঞ্জলি’ বাড়িটির দূরত্ব প্রায় চার কিলোমিটার। এখানে প্রতি শুক্র ও শনিবার শিশুশিল্পীদের মেলা বসে। বিনা বেতনে শেখানো হয় ছবি আঁকা।

চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের শিষ্য শিল্পী বিমানেশ বিশ্বাসের বাড়ি এটি। এখানে মাছিমদিয়া, বেতবাড়িয়া, ধোপাখোলা, হাটবাড়িয়া, রূপগঞ্জ, দুর্গাপুর, ভাদুলীডাঙ্গা, দক্ষিণ নড়াইল, উজিরপুর, বিজয়পুরসহ প্রায় ১৩টি গ্রাম থেকে শিশুরা ছবি আঁকা শিখতে আসে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বিমানেশ বিশ্বাস বলেন, ‘আমি আমার গুরু এস এম সুলতানের নির্দেশ পালন করছি মাত্র। তিনি মারা যাওয়ার আগে বলেছিলেন, “বিমানেশ, তুমি শিশুদের ছেড়ে দিয়ো না, ধরে রেখো।” দীর্ঘদিন ধরে শিশুদের ছবি আঁকা শেখাই। তাদের দিয়ে “নড়াইলের শিশুদের পাঁচালি” নামে ছবি আঁকা শুরু করেছি। আমার জানামতে, এর আগে বিশ্বের কোনো দেশে এত দীর্ঘ আমেরিকান কার্ট্রিজ পেপারের ওপর শিশুদের ছবি আঁকা হয়নি।’

শিশুদের রংতুলির খেলা
২০০৫ সালে নড়াইল শহরের রূপগঞ্জ শিবশংকর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের বারান্দায় পাশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের ৪০ থেকে ৫০ জন শিশুকে নিয়ে আর্ট স্কুলের কার্যক্রম শুরু করা হয়। দেড় বছর চলার পর আর্থিক সংকটে এটি বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৭ সালে দক্ষিণ কুড়িগ্রামে বিমানেশ বিশ্বাসের বাড়ির উঠানে ছাপরা তুলে আবার এর কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১২ সালে পৌরসভার বেতবাড়িয়ায় একটি স্কুলে এর শাখা চালু হয়। ২০১৬ সালে এর শাখা বিভিন্ন গ্রাম ছাড়িয়ে জেলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে।
নড়াইল সদর উপজেলার মুলিয়া ইউনিয়নের বরেন্দার পঞ্চমন্দির, কলোড়া ইউনিয়নের নলদীরচর বৃদ্ধাশ্রম, গোবরা মন্দির, চণ্ডীতলা পালপাড়া, নড়াইল জমিদারবাড়ি (দিঘিরপাড়), বেতবাড়িয়া এবং খুলনার বটিয়াঘাটা হাটবাড়ী মন্দিরসহ নয়টি শাখায় এখন এই কার্যক্রম চলছে। প্রতি শুক্র ও শনিবার শাখাগুলোতে শিশুরা রংতুলির উৎসবে মেতে ওঠে। বিমানেশ বিশ্বাসের অনুপ্রেরণায় একদল তরুণ এই আনন্দ কর্মযজ্ঞে সক্রিয় সহায়তা করছেন। আঁকাজোকার এই আনন্দমেলায় গেলে মনে হয়, চঞ্চল শিশুরা রংতুলি নিয়ে প্রাণের আনন্দে খেলছে।
‘শিল্পাঞ্জলি’তে শিল্পী বিমানেশ বিশ্বাস ছাড়াও তাঁর মেয়ে হীরা বিশ্বাস (রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন), অন্তরা বৈরাগী, সৌমিত্র মোস্তাবি ও তপু দাস শিশুদের ছবি আঁকা শেখান। শাখা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সহযোগিতা করেন বরেন্দায় অনিতা সরকার, বৃদ্ধাশ্রমে সুজিত সাধু ও টুকু রানী, গোবরায় বুবলি সাহা, চণ্ডীতলায় দেবরঞ্জন চক্রবর্তী, দিঘিরপাড়ে গৌরাঙ্গ সরদার, বেতবাড়িয়ায় দুর্গারানী সরকার ও বটিয়াঘাটায় নিরুবিন্দু রায়।

শিশুদের পাঁচালি
চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। তাঁর কথা মনে রেখেই শিল্পাঞ্জলির উদ্যোগে এখানকার খুদে শিল্পীরা ‘শিশুদের পাঁচালি’ নামে বিশাল ক্যানভাসে ছবি আঁকা শুরু করেছে। ২ হাজার ৯১৬ বর্গফুট (১ হাজার ফুট লম্বা, ৩৫ ইঞ্চি চওড়া) কার্ট্রিজের ওপর ছবি এঁকে তারা ইতিহাসের পাতায় নাম লেখাতে চায়। জানান দিতে চায়, শিল্পগুরু এস এম সুলতানের স্বপ্নবীজ এখনো দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। ইতিমধ্যে ১ হাজার ৯০০ বর্গফুট ছবি আঁকা শেষ হয়েছে। ৭০ জন শিশুশিল্পী এ কাজে অংশ নিচ্ছে। এসব শিশুর বেশির ভাগ আদিবাসী সম্প্রদায় ও অসচ্ছল পরিবারের সন্তান। শিশুদের খাতা, রং-পেনসিলসহ ছবি আঁকার বিভিন্ন উপকরণ বিনা মূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে। দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিশুরা মোম রং দিয়ে ছবিগুলো আঁকছে।
পাঁচালিতে আঁকা ছবির মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা দিবস, শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, মসজিদ, মন্দির, গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রা, কৃষক, খেলাধুলা, মৎস্য শিকার, বিয়ের অনুষ্ঠান, শহর ইত্যাদি স্থান পেয়েছে।
শিল্পী বিমানেশ বিশ্বাস বলেন, ‘বড় কাগজে ছবি আঁকলে সেগুলো সংরক্ষণ করা সম্ভব। তাই শিশুদের দিয়ে আমেরিকান কার্টিস পেপারের ওপর বিশাল দৈর্ঘ্যে ছবি আঁকা শুরু করেছি। মোম রং দিয়ে শিশুরা ওদের ইচ্ছেমতো নিজেদের ভাবনায় বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ছবি আঁকছে।’ তাঁর ইচ্ছা, ছবিটি প্রিন্ট করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রদর্শন করে শিশুদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করা।