জঙ্গিরা হটেছে, তবে বসে নেই

সিলেটের আতিয়া মহলে জঙ্গিবিরোধী অভিযান। ফাইল ছবি
সিলেটের আতিয়া মহলে জঙ্গিবিরোধী অভিযান। ফাইল ছবি

হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ভয়াবহ জঙ্গি হামলার রেশ ছিল ২০১৭ সালেও। তবে এ বছর জঙ্গিদের বিরুদ্ধের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একের পর এক অভিযানের ঘটনা ঘটেছে। এতে শীর্ষস্থানীয় জঙ্গি নেতা মাইনুল ওরফে মুসাসহ ৩৪ জঙ্গি নিহত হয়েছেন। ধরা পড়েন জেএমবির উত্তরাঞ্চলীয় কমান্ডার সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজও। জঙ্গিবিরোধী এসব অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সফল হয়েছে। তাই বলে জঙ্গিরা বসে নেই। তলে তলে তারা যে তৎপর, নানা ঘটনায় তা দৃশ্যমান।

বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে জঙ্গিরা। একই সঙ্গে আস্তানা গেড়ে সংগঠিত হওয়ারও চেষ্টা ছিল। মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় জঙ্গিরা এ বছর মাথাচাড়া দিতে পারেনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন বাহিনীর তৎপরতার কারণে হামলা বা ঘাঁটি গাড়ার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় জঙ্গিরা এখন কোণঠাসা। তবে জঙ্গিরা বসে নেই, মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার ও বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান মো. ছানোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজানে হামলার মাধ্যমে জঙ্গিরা সফল হয়েছিল। এরপরই পাল্টা জবাব দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই ধারাবাহিক অভিযানের কারণে জঙ্গিরা সফল আক্রমণ করতে পারেনি । তিনি বলেন, হোলি আর্টিজানের হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজে গতিটা অনেক বেড়ে যায়। এ কারণে জঙ্গিরা সংঘবদ্ধ হতে পারেনি। এতে জঙ্গি হামলার ঝুঁকির মাত্রা অনেকটা কমে এসেছে।

২০১৭ সালের জঙ্গি তৎপরতা ও হামলার ঘটনাগুলো ধারাবাহিকভাবে ঘটেছে। একটি ঘটনার সঙ্গে পরবর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া আরেকটি ঘটনার যোগসূত্র পাওয়া যায়। ৭ মার্চ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার চান্দিনার কুটুম্বপুর এলাকায় শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসে তল্লাশি চালাতে যায় পুলিশ। এ সময় দৌড়ে বাস থেকে নেমে যায় দুই জঙ্গি। একপর্যায়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা ছোড়ে তারা। পরে জসীম উদ্দীন (২৪) ও মো. হাসান (২২) নামের দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের ‘রিদওয়ান মঞ্জিল’ নামের একটি বাড়ি থেকে ২৯টি গ্রেনেড (বোমা), ৯টি চাপাতি ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে পুলিশ। এই বাড়িতেই ভাড়া থাকত ওই দুই জঙ্গি। তাদের সঙ্গে এক শিশু ও এক নারী থাকতেন। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি শিশুসহ ওই নারী বেড়ানোর কথা বলে চলে যান।

পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার হওয়া জসীম উদ্দিন ও মো. হাসানের সঙ্গে নব্য জেএমবির নেতা মাইনুল ওরফে মুসার যোগাযোগ ছিল। জসীম উদ্দীনের প্রকৃত নাম আহমেদ আজওয়াদ ইমতিয়াজ তালুকদার ওরফে অমি। আজওয়াদের বাবা একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা এবং মা ব্যাংক কর্মকর্তা। রাজধানীর পল্লবীতে ফুফুর বাসায় থাকতেন আজওয়াদ। পড়তেন উত্তরার একটি ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, এ লেভেলে। ২০১৬ সালে আজওয়াদ নিখোঁজ হন। গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর র‍্যাব যে ২৬২ জন নিখোঁজ ব্যক্তির তালিকা দেয়, এতে আজওয়াদের নাম ছিল। ওই সময় পুলিশ বলেছিল, বই কেনার কথা বলে আজওয়াদ বাসা থেকে বের হন। আরেক যুবক হাসানের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ায়। ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার কারণে জঙ্গিরা নিরাপদ আস্তানা হিসেবে মীরসরাইয়ের রিদওয়ান মঞ্জিল নামের বাড়িটি ভাড়া নেয়। সেখানে প্রায়ই আসতেন নব্য জেএমবির বর্তমান প্রধান মুসা। ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর আশকোনার সূর্য ভিলা নামের বাড়ি থেকে পুলিশের হাত ফসকে পালিয়ে যান তিনি।

এরপর ১৫ মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড পৌরসভার প্রেমতলা চৌধুরীপাড়া এলাকার ‘ছায়ানীড়’ নামের দোতলা একটি বাড়ি ঘিরে রাখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সীতাকুণ্ড পৌর এলাকার সাধন কুটির একটি বাড়ির মালিকের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ। ওই বাড়ির মালিকই প্রথমে পৌরসভার আমিরাবাদ এলাকায় তাঁর দোতলা বাড়িতে পুলিশকে ডেকে আনেন। বাড়ির ভাড়াটে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত, এমন সন্দেহের কথা পুলিশকে জানান তিনি। পরে বাড়ির নিচতলার একটি ফ্ল্যাট থেকে তিনটি গ্রেনেড, একটি সুইসাইড ভেস্ট (আত্মঘাতী হামলার জন্য বোমার তৈরি বেল্ট), পিস্তল, বুলেট, বোমা তৈরির বিপুল সরঞ্জামসহ গ্রেপ্তার করা হয় এক দম্পতিকে। তাঁদের সঙ্গে দুই মাসের একটি শিশুও রয়েছে। গ্রেপ্তার দুজনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই প্রেমতলা চৌধুরীপাড়া এলাকার ছায়ানীড় বাড়িতে অভিযানে যায় পুলিশ।

১৭ মার্চ ছায়ানীড়ে টানা ১৯ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর জঙ্গিবিরোধী অভিযান শেষে নারীসহ চার জঙ্গি ও এক শিশু নিহত হয়। আত্মঘাতী বিস্ফোরণে এক নারীসহ দুই জঙ্গির হাত-পা ও মাথা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এর এক দিন পর ১৮ মার্চ শুক্রবার দুপুরে রাজধানী ঢাকায় র‍্যাব সদর দপ্তরের ফোর্সেস ব্যারাকে আত্মঘাতী হামলা হয়। এতে র‍্যাবের দুই সদস্য আহত হন। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্থাপনার ভেতরে জঙ্গিদের এ ধরনের হামলা এটাই ছিল প্রথম। বিকট বিস্ফোরণে আশপাশ কেঁপে ওঠে, হামলাকারীর শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে রক্ত-মাংস সীমানাদেয়ালের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। র‍্যাব জানায়, এটি আত্মঘাতী জঙ্গি হামলা।

এক দিন পর ১৯ মার্চ ভোরে খিলগাঁওয়ে র‍্যাবের তল্লাশিচৌকি অতিক্রমের চেষ্টা করেন মোটরসাইকেলের আরোহী এক যুবক। সংকেত না মেনে চলে যাওয়ার সময় র‍্যাব সদস্যদের গুলিতে ওই যুবক নিহত হন। এ ঘটনার তিন দিন পর ২৩ মার্চ সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকার ‘আতিয়া মহল’ নামের একটি বাড়ির নিচতলার একটি ফ্ল্যাটে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর ভেতরে ছিলেন নব্য জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ নেতা মাইনুল ওরফে মুসা। ২৪ মার্চ ঢাকা থেকে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াট সিলেটে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে ঘটনাস্থল ঘেরাও করে। ওই দিন রাতে ঢাকায় বিমানবন্দর গোলচত্বরে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে এক জঙ্গি নিহত হয়।

২৫ মার্চ সকালে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো দল ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ নামে আতিয়া মহলে অভিযান শুরু করে। এই অভিযানের মধ্যেই ওই দিন সন্ধ্যায় শিববাড়ি এলাকায় দুই দফা বিস্ফোরণে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৭ জন নিহত এবং আরও ৪৪ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে ৩০ মার্চ মারা যান র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুল কালাম আজাদ। ২৭ মার্চ সেনাবাহিনীর অভিযানে আতিয়া মহলের ভেতরে মাইনুল ওরফে মুসাসহ চার জঙ্গি নিহত হন। তাঁদের মধ্যে আরও দুজন পুরুষ ছাড়াও একজন নারী ছিলেন।

সিলেটে ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ শেষ হওয়ার ছয় ঘণ্টার মাথায় ২৮ মার্চ গভীর রাতে মৌলভীবাজারে দুটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শুরু করে পুলিশ। ‘অপারেশন হিট ব্যাক’ নামের এই অভিযানে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সঙ্গে সোয়াটও যোগ দেয়। ওই দিন রাত দেড়টার দিকে শহরের বড়হাট আবুশাহ দাখিল মাদ্রাসা গলিতে দোতলা একটি বাড়ি জঙ্গি আস্তানা হিসেবে শনাক্ত করে ঘিরে ফেলে পুলিশ। এরপর ভোরে শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে নাসিরপুর গ্রামে আরেকটি জঙ্গি আস্তানা ঘিরে ফেলা হয়। প্রায় ৩৪ ঘণ্টা ঘিরে রাখার পর ৩০ মার্চ নাসিরপুরের জঙ্গি আস্তানাটি থেকে ‘ছিন্নভিন্ন সাত থেকে আটজনের লাশের অংশ’ পাওয়া যায়। পুলিশের ধারণা, নিহত লোকজন একই পরিবারের সদস্য। আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তারা নিহত হয়।

১১ মে গোদাগাড়ী উপজেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে বেনীপুর গ্রামের ধানখেতের মাঝে এক বাড়িতে অভিযান শুরু করে পুলিশ। অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন সান ডেভিল’। এই অভিযানের শুরুতে জঙ্গিরা আবদুল মতিন নামে ফায়ার সার্ভিসের এক সদস্যকে হত্যা করে। এরপর অভিযানে জঙ্গি সাজ্জাদ আলীসহ (৫০) পাঁচজন নিহত হন। অক্ষত অবস্থায় সাজ্জাদ আলীর এক মেয়ে ও তাঁর দুই শিশুসন্তানকে উদ্ধার করে পুলিশ।

১৫ আগস্ট ভোরবেলা পান্থপথে ওলিও ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি হোটেল ঘিরে ফেলে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। সকালে ‘অপারেশন আগস্ট বাইট’ নামের ওই অভিযানের সময় আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু তাতে সাড়া না দিয়ে সাইফুল ইসলাম নামের এক যুবক সুইসাইড ভেস্টে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিহত হন।

৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর দারুস সালাম এলাকার কমলপ্রভা নামের একটি বাড়িতে র‍্যাবের অভিযানে আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জঙ্গি আবদুল্লাহসহ সাতজন নিহত হন।

২৭ নভেম্বর সোমবার দিবাগত রাত তিনটায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের দুর্গম পদ্মার চর আলাতুলি মধ্যপাড়ায় র‍্যাবের অভিযানে তিন জঙ্গি নিহত হয়।

জঙ্গিবিষয়ক বিশ্লেষক মো. নূর খান বলেন, গুলশানে হলি আর্টিজানের ঘটনার পর ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও জঙ্গিদের তেমন কোনো বড় আক্রমণের ঘটনা ঘটেনি। এই বছর বলা চলে জঙ্গিরা এখন নিঃশেষের পর্যায়ে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তারা প্রচণ্ড চাপের মধ্যে আছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশেও এই মুহূর্তে জঙ্গিরা কোণঠাসা অবস্থায় আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর তৎপরতার কারণে অনেক ঘটনা ব্যর্থ হয়েছে। মার্চ মাসে আশকোনায় র‍্যাব ব্যারাকে ও বিমানবন্দর চত্বরে আক্রমণ সফল ছিল না। আক্রমণকারী আত্মঘাতী হয়ে নিহত হয়েছে।

জঙ্গি তৎপরতা চিহ্নিত ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সক্ষমতা এ বছর বেড়েছে, মন্তব্য করে নূর খান লিটন বলেন, ২০১৭ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী প্রায় ২৫টি আস্তানার সন্ধান পেয়ে অভিযান চালিয়েছে। এসব অভিযানে ৩০ থেকে ৪০ জন জঙ্গি মারা গেছে। গ্রেপ্তার হয়েছে অর্ধশতাধিক জঙ্গি। তাঁর মতে, যেকোনো সময় জঙ্গিদের উত্থান ঘটতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা সফলতার মুখ দেখলেও জঙ্গিবাদের আদর্শিক মোকাবিলায় যে রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রয়োজন, তা অনুপস্থিত।