আলোহীন কালাকচুর বুননের আলো

নিজ বাড়ির আঙিনায় বসে বাঁশের ঝুড়ি তৈরি করছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কালাকচু চাকমা। খাগড়াছড়ির দীঘিনালার উপজেলার জোড়াব্রিজ এলাকার বাড়িতে l প্রথম আলো
নিজ বাড়ির আঙিনায় বসে বাঁশের ঝুড়ি তৈরি করছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কালাকচু চাকমা। খাগড়াছড়ির দীঘিনালার উপজেলার জোড়াব্রিজ এলাকার বাড়িতে l প্রথম আলো

মাত্র আট বছর বয়সে টাইফয়েডে দুই চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন খাগড়াছড়ির দীঘিনালার কালাকচু চাকমা। চোখের আলো নেই তাঁর। তবু নিপুণ হাতে তৈরি করেন বাঁশের ঝুড়ি, ডালাসহ নানা পণ্য। বাঁশের যেকোনো পণ্যের ওপর হাত বুলিয়ে বুননটা বুঝতে পারেন তিনি। এরপর মনের আলোয় বাঁশের ফালি থেকে নিজেই তৈরি করেন অদেখা সেই পণ্য। তাঁর সচল হাতেই চলছে সংসার।

দীঘিনালা উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে দীঘিনালা-বাঘাইহাট সড়কের পাশে জোড়াব্রিজ এলাকা। এখান থেকে এক কিলোমিটার দক্ষিণে গেলে কালাকচু চাকমার বাড়ি। ৫৩ বছর বয়সী এই হস্তশিল্পী বাঁশের পণ্য তৈরি করেই সংসার চালান। সম্প্রতি তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, জরাজীর্ণ ছনের ছাউনির ঘরের সামনের বসে ঝুড়ি বানাচ্ছেন তিনি। কাজের ফাঁকে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। জানালেন, লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি। আট বছর বয়সে ডায়রিয়া ও টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারান। ২১ বছর বয়সে বাবা তাঁকে বিয়ে দেন। বিয়ের কিছুদিন পরই বাবা মারা যান। এরপরই সংসার কীভাবে চালাবেন সে চিন্তা করতে করতে মাথায় আসে বাঁশ দিয়ে কৃষিপণ্য তৈরি করবেন। কিন্তু কীভাবে? স্ত্রী নিরতা চাকমার সঙ্গে পরামর্শ করলেন। স্ত্রী কয়েকটি বাঁশের কৃষিপণ্য জোগাড় করে এনে দিলেন। আর সেই পণ্যের গায়ে হাত বুলিয়েই চেষ্টা করলেন তেমন কিছু একটা বানাতে। সফলও হলেন। সেই থেকেই শুরু হলো নতুন যুদ্ধ। স্ত্রী পাহাড় থেকে বাঁশ কেটে এনে দেন। আর সে বাঁশ থেকে কালাকচু চাকমা তৈরি করেন কৃষিপণ্য। সেগুলো সাপ্তাহিক হাটবারে নিয়ে বিক্রি করেন স্ত্রী। এভাবেই চলছে তাঁদের চারজনের সংসার।

কালাকচু চাকমার স্ত্রী নিরতা চাকমা বলেন, তাঁদের সংসারে এক ছেলে, তিন মেয়ে। এক ছেলে ও এক মেয়ে বিয়ে করে আলাদা সংসার করেছে। ছোট দুই মেয়ে নিয়ে তাঁদের চারজনের সংসার। তিনি পাহাড় থেকে বাঁশ কেটে এনে দেন। আর সে বাঁশ দিয়ে স্বামী কাল্লুং (ঝুড়ি) তৈরি করেন। সেগুলো বাজারে বিক্রি করেন তিনি। সপ্তাহে পাঁচ থেকে ছয়টি কাল্লুং বানাতে পারেন। প্রতিটি দেড় শ থেকে দুই শ টাকায় বিক্রি করেন। এ টাকায় তাঁদের সংসার চলে।

কালাকচু চাকমার ঘরের চালা জীর্ণ হয়ে পড়েছে। বৃষ্টির সময় ঘরে পানি পড়ে। বাঁশের পণ্য বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়ে চারজনের খাবার জোগাড় করতে কষ্ট হয়। ঘর মেরামত করতে পারলে কষ্টটা একটু কমবে বলে জানালেন তিনি।

কালাকচুর প্রতিবেশী লক্ষ্মী বিজয় চাকমা বলেন, তাঁকে দেখে খুব শ্রদ্ধা হয়। চোখের দৃষ্টি নেই। কিন্তু বাঁশ দিয়ে যেভাবে কৃষিপণ্য তৈরি করেন তা অবিশ্বাস্য। তবে যে ঘরে তাঁরা থাকেন সেটি বসবাসের যোগ্য নয়। ঘরটি সংস্কার করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কনসার্ন সার্ভিসেস ফর ডিজঅ্যাবলড (সিএসডি) এর সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিত দাশগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘কালাকচু চাকমার কাহিনি শুনে সত্যি তাঁর প্রতি খুব শ্রদ্ধা হচ্ছে। আমরা প্রতিবন্ধীদের প্রতিবন্ধী বলি না, বলি প্রতিযোগী। কালাকচু চাকমাও তাঁদের একজন। আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁকে সহযোগিতা করা হবে।’