গ্রাম ঘুরে পশুপাখির টিকা দেন সালমা

দিনাজপুরে গৃহপালিত পশুপাখির টিকাদানকর্মী সালমা। ছবি: প্রথম আলো
দিনাজপুরে গৃহপালিত পশুপাখির টিকাদানকর্মী সালমা। ছবি: প্রথম আলো

চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবার মৃত্যুর হয়। বিয়ে হয় পরের বছর। সালটা ১৯৯০। এর তিন বছরের মাথায় কাঁচামালের ব্যবসায়ী স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় শ্বশুর-শাশুড়ি আলাদা করে দেন তাঁদের। জমিজমা না থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েন সালমা। ১৯৯৬ সালে কোলজুড়ে আসে মেয়ে। স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়ে সালমার। সিদ্ধান্ত নেন নিজে কিছু করার। শুরু করেন পশুর চিকিৎসাসেবাসহ টিকাদানের প্রশিক্ষণ।

নারীদের জন্য ব্যতিক্রমী এই পেশায় সালমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ান স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, সমাজ। শুরু হয় নির্যাতন, ভর্ৎসনা। কিন্তু কিছুই দমাতে পারেনি সালমার সিদ্ধান্তকে। সবকিছু ছাপিয়ে তিনি এখন দিনাজপুরের গৃহপালিত পশুর একমাত্র টিকাদানকর্মী।

সালমা বেগম খানসামা উপজেলার দক্ষিণ বালাপাড়া গ্রামের মজিব উদ্দিনের স্ত্রী। তিনি সাইকেল চালিয়ে গ্রামে গ্রামে গবাদি পশুপাখির চিকিৎসা দেন। চালু করেছেন পশুখাদ্যের দোকান। এসব করে মাসে কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকা আয় করেন তিনি। নিজে না পারলেও তিন মেয়েকে করাচ্ছেন লেখাপড়া।

জানতে চাইলে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আলতাফ হোসেন বলেন, তাঁর এক যুগের চাকরিজীবনে কোনো নারীকে এই পেশায় দেখেননি। একজন নারী হিসেবে সালমার কাজ প্রাণিসম্পদ শাখায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তিনি একজন সফল টিকাদানকর্মী।

যেভাবে শুরু

সালমার মালিকানাধীন ‘বালাপাড়া নতুন জীবন ফিড হাউসে’ বসে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে পরিচয় হয় দীপ শিখা নামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মো. এনামুল ও মো. মোস্তফা নামের দুই কর্মকর্তার সঙ্গে। তাঁর দুর্দশার কথা জেনে পরামর্শ দেন ছাগল ও হাঁস-মুরগি পালনের প্রশিক্ষণ নেওয়ার। প্রশিক্ষণ শেষে ঋণ হিসেবে তিনটি ছাগল দেওয়া হবে জেনে সাত দিনের প্রশিক্ষণ নেন তিনি। দীপ শিখার আয়োজনে স্থানীয় খামারপাড়া ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) সাত দিনের প্রশিক্ষণ নেন। সে সময় গ্রামাঞ্চলে হাঁস-মুরগির বিভিন্ন রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। সালমা হাঁস-মুরগির টিকা দেওয়া শুরু করেন। সেই সঙ্গে চিকিৎসাসেবা। ধীরে ধীরে এলাকায় সালমার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন এলাকা থেকে ডাক আসতে শুরু করে তাঁর।

খামারপাড়া ইউপির চেয়ারম্যান সাজেদুল হক প্রথমআলোকে বলেন, পশু চিকিৎসক হিসেবে সালমা বেগম এলাকায় খুব পরিচিত। তাঁর ইউনিয়নসহ আশপাশের অনেক ইউনিয়নে সালমা বেগমের নামডাক।

বাধা পেরিয়ে

সালমা বেগম জানান, কাজের গতি যত বাড়তে থাকল, স্বামীর বাধা ততই বাড়তে থাকল। বাধা একসময় পরিণত হলো নির্যাতনে। কাজের প্রয়োজনে শেখেন সাইকেল চালানো। বাড়ি থেকে যেন বের হতে না পারেন, সে জন্য ফুটো করে দেওয়া হতো সাইকেলের চাকা। নষ্ট করে রাখা হতো মুঠোফোন। কিন্তু কিছুই আটকাতে পারেনি তাঁকে। তিনি গ্রামে গ্রামে হাঁস-মুরগির টিকা দিতে গিয়ে লক্ষ করেন, গরু-ছাগলসহ গৃহপালিত অন্য পশুদের রোগাক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাও অনেক। সে তুলনায় চিকিৎসক ও চিকিৎসাসেবা অপ্রতুল। সিদ্ধান্ত নেন পশুর চিকিৎসা দেওয়ার। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের সহযোগিতা চান তিনি। ২০০৫ সালে সুযোগ আসে প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের অধীনে এক মাসের প্রশিক্ষণের। প্রশিক্ষণটি গাইবান্ধায় হওয়ায় আবারও বাধা আসে পরিবার থেকে। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অটল সালমা প্রশিক্ষণে যান। এতে তৎকালীন প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবদুস সালাম তাঁকে উৎসাহ ও সহযোগিতা করেন। তিনি গাইবান্ধায় লাইভ স্টক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে ‘গাভি ও ছাগল পালন, মোটাতাজাকরণ ও চিকিৎসা’ বিষয়ে এক মাসের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে প্রথম দিকে প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করেন। দ্রুত গৃহপালিত পশুর টিকাদানসহ চিকিৎসাসেবায় দক্ষ হয়ে ওঠেন সালমা। শুরু করেন মাঠপর্যায়ে কাজ। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাঁকে।

অবশেষে সফল

১৯৯৭ সালে সালমার কোলে আসে দ্বিতীয় এবং ২০০২ সালে আসে তৃতীয় মেয়ে। নিজে লেখাপড়া করতে না পারার জেদ থেকে সিদ্ধান্ত নেন, সন্তানদের যেভাবেই হোক লেখাপড়া করাবেন। গবাদিপশুর চিকিৎসাসেবা ও টিকাদানেরএ কাজ করে পরিবারের সচ্ছলতার পাশাপাশি তিন মেয়েকে লেখাপড়া করিয়েছেন। এখন বড় মেয়ে রুমি আক্তার স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষে, দ্বিতীয় মেয়ে মোস্তারিনা আক্তার উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। তৃতীয় মেয়ে মাহফুজা আক্তার এবার জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা দিয়েছে। স্বামীরঅস্ত্রোপচারসহ চালিয়েছেন চিকিৎসা। চালু করেছেন ফিডের দোকান।

সালমার স্বামী মজিব উদ্দিন বলেন, এখন আর তিনি সালমার কাজে বাধা দেন না; বরং পারলে তাঁকে সাহায্য করেন।

জানতে চাইলে জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আশিকা আকবর বলেন, বড় পরিসরে (গরু-মহিষ) গৃহপালিত পশুপাখির টিকা ও সেবাদানকারী হিসেবে জেলার একমাত্র নারী কর্মী সালমা বেগম। তিনি এই পেশায় অনুপ্রেরণাদায়ী। সালমাকে সামনে রেখে অনেক নারীই এখন এই পেশায় আসার আগ্রহ দেখাচ্ছেন।