এক মানবদরদির শেষ ইচ্ছা

লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হল
লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হল

লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হল্ট। ৮৭ বছর বয়সী মানবদরদি একজন ব্রিটিশ নারী। ৫৭ বছর ধরে এ দেশে মানুষের সেবা করছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে তিনি যুদ্ধাহত ব্যক্তিদের শুশ্রূষা দিয়েছেন। অবসর মিলেছে তাঁর। কিন্তু জন্মভূমিতে ফিরে যাননি। এ দেশের মাটি, মানুষ আর বাতাস ভালোবেসে এখানেই থেকে গেছেন। এখন তিনি বরিশাল নগরের অক্সফোর্ড মিশনে দুস্থ শিশুদের অবৈতনিক ইংরেজি শিক্ষক। শেষ ইচ্ছা যেন তাঁকে এই মাটির বুকেই শুইয়ে দেওয়া হয় চিরনিদ্রায়। মৃত্যুর আগে তিনি এই দেশের নাগরিকত্ব পেতে চান। এ জন্য বেশ কয়েকবার আবেদন করেও বিফল হয়েছেন। কিন্তু হাল ছাড়েননি।

লুসি হেলেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ দেশের দাপ্তরিক কাজ খুব জটিল লাগে। তবে আমার বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা জানেন না। যদি তিনি (শেখ হাসিনা) জানতেন, এ দেশে এমন একজন বৃদ্ধ নারী আছেন, যাঁর শেষ ইচ্ছা, তাঁকে যেন এখানেই সমাহিত করা হয়, তবে তিনি নির্দ্বিধায় আমার দ্বৈত নাগরিকত্বের আবেদনটি অনুমোদন করে দিতেন।’

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সিস্টার লুসি কাজ করতেন যশোর ক্যাথলিক চার্চে। সেখানে স্কুলে শিশুদের ইংরেজি পড়াতেন। যুদ্ধ শুরু হলে চার্চটি বন্ধ করে মিশনের সবাই খুলনায় নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। কিন্তু লুসি যাননি। নিজের জীবন বিপন্ন হতে পারে জেনেও তিনি ছুটে যান পাশের ফাতেমা হাসপাতালে। সেখানে অসংখ্য আহত বেসামরিক নারী, পুরুষ, শিশুর কান্না-আহাজারিতে তাঁর হৃদয় কাঁদছিল। তিনি হাসপাতালে গেলেন এবং অসহায় মানুষদের সেবা দিতে চাইলেন। চিকিৎসকেরা ভিনদেশি এক নারীর এমন আগ্রহ দেখে বিস্মিত হন এবং সানন্দে সম্মতি দেন। এরপর থেকে তিনি যুদ্ধাহত ব্যক্তিদের শুশ্রূষা দিতে থাকেন।

মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখায় গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে লুসিকে সম্মাননা দেয় বরিশাল মহানগর পুলিশ। তাঁর হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন নগর পুলিশের কমিশনার এস এম রুহুল আমীন।

লুসির জন্ম ১৯৩০ সালের ১৬ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যের সেন্ট হ্যালেন্সে। বাবা জন হল্ট ও মা ফ্রান্সিস হল্ট। দুই বোনের মধ্যে ছোট লুসি। তাঁর বড় বোন রুৎ অ্যান রেভা ফেলটন। স্বামী ও তিন ছেলে নিয়ে তিনি ব্রিটেনেই বসবাস করেন। লুসি ১৯৪৮ সালে উচ্চমাধ্যমিক (দ্বাদশ) পাস করেন। তিনি ১৯৬০ সালে প্রথম বাংলাদেশে আসেন। যোগ দেন বরিশাল অক্সফোর্ড মিশনে। এখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের পড়াতেন। এরপর আর দেশে ফিরে যাননি। ৫৭ বছর ধরে ঘুরেফিরে তিনি কাজ করেছেন যশোর, খুলনা, নওগাঁ, ঢাকা ও গোপালগঞ্জে।

২০০৪ সালে অবসরে যান লুসি। ওই বছরই তিনি ফিরে আসেন বরিশালের অক্সফোর্ড মিশনে। এই অবসরজীবনে দুস্থ শিশুদের মানসিক বিকাশ ও ইংরেজি শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি এসব শিশুর জন্য দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহের কাজ করছেন। বয়সকে তিনি পাত্তাই দেন না। লুসি বলেন, বয়স কাউকে বেঁধে রাখতে পারে না, যদি ইচ্ছা থাকে। একজন মানুষ সময়কে কাজে লাগিয়ে মানুষ, সমাজ ও দেশের জন্য অনেক অবদান রাখতে পারেন।

সম্প্রতি বরিশাল অক্সফোর্ড মিশনে কথা হয় সিস্টার লুসির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এ দেশের সঙ্গে আমার জীবনের একটা গভীর যোগসূত্র আছে। কারণ, বাংলাদেশের জন্ম ১৬ ডিসেম্বর আর আমার জন্মও একই দিনে। এটা কাকতালীয় হলেও বিষয়টি আমাকে খুব ভাবায়। হয়তো এটা ঈশ্বরের খেয়াল! অবসর গ্রহণের পর সবাই দেশে ফিরে যায়। কিন্তু এই দেশকে এত ভালোবেসে ফেলেছি যে, এর মায়া ছেড়ে যেতে মন সায় দেয়নি। তাই জীবনের সেরা সময়গুলো কাটানো এই বরিশালেই ফিরে এসেছি। মৃত্যুর পর এখানের মাটিতেই সমাহিত হতে চাই।’

লুসি আরও বলেন, ‘বেশ কয়েকবার এ দেশে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছি। প্রতিবছর অনেক টাকা দিয়ে ভিসার মেয়াদ বাড়াতে হচ্ছে। গেল বছর ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি করতে ৩৮ হাজার টাকা লেগেছে। আমি এখন অবসর ভাতা পাচ্ছি ৭৫ পাউন্ড, যা বাংলাদেশের সাড়ে সাত হাজার টাকার সমান। সামান্য এই অর্থ থেকে বাঁচিয়ে আমাকে ভিসার জন্য ব্যয় করতে হয়।’

বরিশাল অক্সফোর্ড মিশনের দক্ষিণ দিকটায় টিনের ছোট্ট ঘর, জরাজীর্ণ। বারান্দার এক অংশে লুসির থাকার ব্যবস্থা। সেখানে ছোট্ট একটি কাঠের চৌকি, কাঠের দুটি টেবিল। শোয়ার চৌকিতে পাতলা তোশক বিছানো, একটি বালিশ আর কম দামের কম্বল। পাশে শেলফে কিছু বই ও পুরোনো ডায়েরি।

জানতে চাইলে বরিশালের জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করে যে মহৎপ্রাণ নারী এ দেশের মায়ায় আবদ্ধ হয়ে আছেন, তা দেখে আমি মুগ্ধ। আমি তাঁর চোখে-মুখে বাংলাদেশ ও এ দেশের মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা দেখেছি। আমি চেষ্টা করছি, যত দ্রুত সম্ভব তাঁর আবেদনের ফাইলটি দেখে এই বিষয়ে ঢাকায় সংশ্লিষ্ট বিভাগে চিঠি লিখব। লুসি হল্টের মতো একজন দরদি নারী এ দেশের নাগরিকত্ব পেলে বরিশালের মানুষ আনন্দিত হবে।’