'বঙ্গবন্ধুর চিঠিটিই সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা'

প্রফুল্ল সরকার
প্রফুল্ল সরকার

পাকিস্তানি হানাদারদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ আর অত্যাচার-নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি আজও তাঁর চোখে ভাসে। ওই স্মৃতির কথা মনে পড়লে তিনি ভয়ে কেঁপে ওঠেন। শহীদদের বুকের রক্তে লাল হয়ে যাওয়া মগড়া নদীর স্রোতোধারা প্রায়ই তাঁর চোখের জলের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। এ কথাগুলো  মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নির্যাতনের শিকার হওয়া প্রফুল্ল সরকারের (৬৬)।

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রফুল্ল সরকারসহ ২৬ জনকে গুলি করে হত্যা করার জন্য ত্রিমোহনী সেতুতে নিয়ে যায় হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। এ সময় আলৌকিকভাবে তিনি প্রাণে রক্ষা পান। তিনি নেত্রকোনা শহরের উকিলপাড়ায় একটি ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে থাকেন। শহরের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপক পদে চাকরি করেন।

সেই গণহত্যার বিভীষিকার বিষয়ে প্রফুল্ল সরকারের সঙ্গে কথা হয় ১৮ ডিসেম্বর। তিনি বলেন, একাত্তরের এপ্রিল মাস। তখন তিনি ২০ বছরের তরুণ। ওই মাসের প্রথম দিকে নেত্রকোনা শহরের নিখিলনাথ সড়ক থেকে একদল রাজাকার তাঁকে ধরে সদর থানায় নিয়ে যায়। পরে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দিয়ে তাঁকে পাঠানো হয় জেলহাজতে। কয়েক মাস কারাগারে থাকার পর জামিনে মুক্তি পান তিনি। সেপ্টেম্বর মাসে আদালতে হাজিরা দিতে গেলে আবারও গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে। ২২ সেপ্টেম্বর তিনিসহ আরও ২৬ জনকে আদালতে হাজির করা হয়। আদালত প্রত্যেককে বেকসুর খালাস দেন। আদালত খালাস দিলেও পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে মুক্তি মেলেনি। ওই দিন আদালতের সামনে থেকেই তাঁদের ফের বন্দী করা হয়।

প্রফুল্ল সরকার বলেন, ২২ সেপ্টেম্বর আদালত থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সারা দিন তাঁদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চলে। হানাদার ও আলবদর বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের রাতে নেত্রকোনা-পূর্বধলা সড়কের মাঝামাঝি মগড়া নদীর ওপর অবস্থিত ত্রিমোহনী সেতুতে নিয়ে যায়। রাত আটটার দিকে প্রত্যেককে জিপ থেকে নামিয়ে হাত-পা বেঁধে সেতুর কাছে নদীর পাড়ে দাঁড় করানো হয়। এরপর প্রথমে তাঁদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জখম করা হয়। শেষে তাঁদের গুলি করা হয়। অন্যরা গুলিতে নিহত হলেও তিনি মরে যাওয়ার ভান করে সেতুর ওপর পড়ে থাকেন। শেষে অন্যদের লাশের সঙ্গে প্রফুল্ল সরকারকেও মগড়া নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। সারা রাত হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নদীর পানিতে থাকার পর অবিশ্বাস্যভাবে বেঁচে যান তিনি।

ওই দিন সুরেন্দ্র চন্দ্র সাহা রায়, কামিনী কুমার চক্রবর্তী, নিশিকান্ত সরকার, সুরেন্দ্র চন্দ্র দে, কমল চন্দ্র সাহা, সুনীল চন্দ্র সাহা, সতীশ চন্দ্র সরকার, দুর্গানাথ চক্রবর্তী, ব্রজেন্দ্র চন্দ্র সরকার, মতিলাল সাহা (১), মতিলাল সাহা(২), পীযূষ কান্তি সাহা, দীপক কুমার সাহা, দিলীপ কুমার পাল, সন্তোষ চন্দ্র পাল (১), সন্তোষ চন্দ্র পাল (২), রমেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী, অজিত কুমার সাহা, সতীশ চন্দ্র সাহা, স্বদেশ দত্ত, যোগেন্দ্র চন্দ্র সরকার, বিনন্দ চন্দ্র দে, মনীন্দ্র চন্দ্র সাহা, বিনয়ভূষণ সরকার ও দীনেশ চন্দ্র সরকার শহীদ হয়েছিলেন।

১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি চিঠি পাঠান প্রফুল্ল সরকারকে। বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘প্রিয় ভাই, আপনি দেশপ্রেমের সুমহান আদর্শ ও প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশমাতৃকার মুক্তিসংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে পাক হানাদার দস্যু বাহিনীর হাতে গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। এই দুঃসাহসিক ঝুঁকি নেওয়ার জন্যে আপনাকে জানাচ্ছি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। “প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল” থেকে আপনার ও আপনার পরিবারের উপকারার্থে আপনার সংশ্লিষ্ট মহকুমা প্রশাসকের কাছে ৫০০ টাকার চেক পাঠানো হলো।’

সবশেষে প্রফুল্ল সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর এই চিঠিটিই আজ তাঁর সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা।’