বাড়িভাড়ায় নতুন নৈরাজ্য

কার্টুন তুলি
কার্টুন তুলি

শুক্রবাদ এলাকার ভাড়াটে বেসরকারি চাকরিজীবী আবদুল মতিনের ফ্ল্যাটের ভাড়া ২৬ হাজার টাকা। এই জানুয়ারি থেকে সেটা হয়েছে ২৯ হাজার টাকা। এক লাফে তিন হাজার টাকা বেড়ে যাওয়ার ব্যাখ্যায় বাড়িওয়ালা বলেছেন, সিটি করপোরেশন গৃহকর বাড়িয়েছে। কিন্তু নতুন গৃহকর যে স্থগিত হয়ে গেছে, সেটা আর ধর্তব্যে নিচ্ছেন না বাড়িওয়ালারা। তাঁদের যুক্তি, যেকোনো মুহূর্তে এই স্থগিতাদেশ উঠে যাবে।

জানা যায়, গত বছরও দ্রব্যমূল্য ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বাড়ার কারণ দেখিয়ে একই বাড়িওয়ালা দুই হাজার টাকা ভাড়া বাড়িয়েছিলেন।

উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরের ২৩ নম্বর সড়কের ২৫ নম্বর বাড়ির দুই কক্ষের ছোট ফ্ল্যাটগুলোর ভাড়া ছিল ১৩ হাজার টাকা করে। ভাড়াটে বেলায়েত হোসেন জানান, দুই হাজার টাকা ভাড়া বাড়ানোর পাশাপাশি বাড়িওয়ালা বলেছেন, এবার থেকে চলতি মাসের ভাড়া ১০ তারিখের মধ্যে আগাম (প্রি-পেইড) দিতে হবে।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১৮টি এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রতিবছরের চেয়ে এবার বাড়িওয়ালারা বাড়িভাড়া বেশি বাড়িয়েছেন গৃহকর বেড়ে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে। অথচ স্থানীয় সরকার বিভাগ গত ১২ ডিসেম্বর ঢাকাসহ সারা দেশের সিটি করপোরেশনের গৃহকর বাড়ানোর প্রক্রিয়া স্থগিত করে।

ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে বাড়িওয়ালাদের যথেচ্ছ আচরণের কথা জানিয়েছেন হাতিরপুল, নিউ ইস্কাটন, মগবাজার, ধানমন্ডি, জিগাতলা, বাসাবো, যাত্রাবাড়ী, ওয়ারী, মোহাম্মদপুরের নুরজাহান রোড, মিরপুরে ১ ও ১২ নম্বর সেকশন এলাকার বাসিন্দারা। ডিএনসিসি এলাকার গুলশান, বনানী, বারিধারা এলাকায় বেশির ভাগ বাড়ির ভাড়া পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। পূর্ব রামপুরার মধ্যবিত্ত ভাড়াটেদের অনেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা ভাড়া বাড়ানোর চিরকুট পেয়েছেন বাড়িওয়ালার কাছ থেকে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, কারণে-অকারণে বাড়িভাড়া বাড়ানো রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। বিষয়টি যে অযৌক্তিক, অনৈতিক এবং ভাড়াটেদের নাভিশ্বাস ওঠার মতো, তা তাঁরা ভাবেন না।

ভাড়া বেড়েছে আড়াই হাজার টাকা

ভাড়াটেদের ১০টি সংগঠন মিলে গঠিত বাংলাদেশ ভাড়াটিয়া ফেডারেশনের হিসাব বলছে, জানুয়ারি থেকে রাজধানীতে গড়ে আড়াই হাজার টাকা করে বেড়েছে বাড়িভাড়া। দুই সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগের হিসাবে ঢাকায় গৃহকর দেয় এমন বাড়ির সংখ্যা ৩ লাখ ৭৫ হাজার। এর ৯০ ভাগ বাড়িতে মানুষ ভাড়া থাকে। এসব বাড়ির ৭৫ ভাগের ভাড়া বাড়ছে। সে হিসাবে ২ লাখ ৫৩ হাজার ১২৫টি বাড়ির ভাড়া বাড়ছে ৬৩ কোটি ২৮ লাখ সাড়ে ১২ হাজার টাকা।

ফেডারেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ভাড়া বাড়ানোর ক্ষেত্রে আইনকানুনের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। ভাড়ার জন্য কোনো রসিদ দেওয়া হচ্ছে না। জোর করে ভাড়াটেদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে।

ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বাহারানে সুলতান বলেন, অনেক বাড়িওয়ালা চলতি মাসের ভাড়াও আগাম (প্রি-পেইড) দিতে হবে বলে ভাড়াটেদের ওপর চাপ দিচ্ছেন। অতীতে যেটা কম ছিল।

ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক হ‌ুমায়ূন কবির ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত যতটা হিসাব করা হয়েছে, তাতে দেখা যায়, নতুন গৃহকরের অজুহাত দেখিয়ে এবার বাড়িভাড়া বাড়ানো হয়েছে।

ক্যাবের হিসাব অনুযায়ী ২০১৬ সালে বাড়িভাড়া বাড়ে ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ওই বছর দুই কক্ষের একটি বাড়ির ভাড়া ছিল ১৯ হাজার ৭০০ টাকা। ’১৭ সালে হয়েছে ২১ হাজার ৩৪০ টাকা। আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ।

সিটি করপোরেশনের দায় নেই

দুই করপোরেশন থেকেই বলা হয়েছে, বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তাদের দেওয়া হয়নি। ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কার্যক্রম স্থগিত করার পরও কোনো বাড়িওয়ালা এটাকে অজুহাত হিসাবে দেখালে তা কিছুতেই সংগত হবে না। কিন্তু আমরা সরাসরি কিছু করতে পারি না। ক্যাবসহ কোনো সংগঠন এ বিষয়ে আলোচনা করতে এলে করণীয় বিষয় জেনে একজন মেয়র হিসেবে যতটা ব্যবস্থা নেওয়ার, তা নেওয়া হবে।’

ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা রবীন্দ্র শ্রী বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, গৃহকর মূল্যায়নের জন্য তাঁদের অধীন পাঁচটি অঞ্চলের বাড়িগুলোতে জরিপকাজ শেষ করা হয়। কিন্তু নতুন কর আরোপ করে কারও কাছে চিঠি পাঠানো হয়নি। তাই গৃহকর বাড়ানোর বিষয়ে সামনে এনে বাড়িভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি অন্যায়।

অন্যদিকে ডিএসসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সরদার বলেন, পাঁচটি অঞ্চলের মধ্যে দুটি অঞ্চলে কর আরোপ করা হলেও গ্রহণকাজ সম্পন্ন হয়নি। বাকি তিনটির জরিপকাজ শেষ হয়নি, কর নির্ধারণের প্রশ্নই ওঠে না।

আইনের বাস্তবায়ন কে করবে

১৯৯১ সালে সরকার ‘বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন’ প্রণয়ন করে। আইনে বলা হয়েছে, দুই বছর পর্যন্ত ভাড়া বাড়ানো যাবে না। বাড়িওয়ালা কোনো ভাড়াটের কাছে জামানত বা কোনো টাকা দাবি করতে পারবেন না। প্রতি মাসে ভাড়া নেওয়ার রসিদ দিতে হবে, নইলে বাড়িওয়ালা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আইনটি বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। আদালতের মাধ্যমে ভাড়াসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির কথা আইনে বলা আছে। ভাড়াটেদের স্বার্থরক্ষায় এমন আরও অনেক কথাই উল্লেখ আছে এই আইনে।

কিন্তু ২৬ বছরেও তার প্রয়োগ বা কার্যকর করা যায়নি। প্রায় আড়াই বছর আগে এ-সংক্রান্ত একটি রিট আবেদন হয়। যে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি রায় লিখেছিলেন, তিনি মারা যাওয়ায় বিষয়টি থেমে আছে।

আইনটি প্রণয়নের পর সিটি করপোরেশনে এলাকাভেদে ভাড়ার হার নির্ধারণ করা হয়। আইনে বিভিন্ন এলাকায় নিয়ন্ত্রক, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রক ও উপনিয়ন্ত্রক নিয়োগের বিধান রয়েছে। কিন্তু এখনো তা নিয়োগ হয়নি। কোন কর্তৃপক্ষ আইন প্রয়োগ করবে, তা-ও ঠিক করা হয়নি।

২০১০ সালে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে রুল ও চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১ জুলাই আদালত রায় দেন। রায়ে বলা হয়, বিদ্যমান আইনটি কার্যকর না হওয়ায় ভাড়াটেকে সুরক্ষা দেওয়া যাচ্ছে না। এটি কার্যকর করতে রাষ্ট্রকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।

রায়ে ভাড়া নির্ধারণের জন্য ছয় মাসের মধ্যে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠনের জন্য সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রায় ঘোষণার আড়াই বছরেও বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ কমিশন গঠিত হয়নি। জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বজলুর রহমান রায় ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু গত বছর তিনি মারা যান।

আইনজীবী মনজিল মোরসেদ প্রথম আলোকে বলেন, যিনি রায় লিখেছেন, তিনি মারা যাওয়ার কারণে বিষয়টি থেমে আছে। প্রধান বিচারপতি হয়তো রায় লেখার জন্য অথবা শুনানির জন্য কাউকে দায়িত্ব দেবেন।