যে গ্রাম সাঁতারু গড়ে

>

আমলা গ্রামের পুকুরে সাঁতার কেটে অনেকে উঠে আসছেন জাতীয় পর্যায়ে। ছবি: তৌহিদী হাসান
আমলা গ্রামের পুকুরে সাঁতার কেটে অনেকে উঠে আসছেন জাতীয় পর্যায়ে। ছবি: তৌহিদী হাসান

কুষ্টিয়ার আমলা গ্রামের খালে বা মজা পুকুরে সাঁতার শিখেছেন, এমন শতাধিক সাঁতারু এখন বিভিন্ন দলের হয়ে খেলছেন জাতীয় পর্যায়ে। এলাকার অনেক কিশোর-তরুণের গলায় শোভা পেয়েছে ১০-১৫টি করে জাতীয় পদক। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সাঁতার প্রতিযোগিতা থেকেও এসেছে সাফল্য। আমলা গ্রামে সাঁতারু গড়ে ওঠার বৃত্তান্ত থাকছে প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে

সারা দিন সূর্যের দেখা মেলেনি। দুপুরে কেটেছে ঘন কুয়াশা, কিন্তু শীতের আঁচ কমেনি। এমন কনকনে শীতে অনেকটা জবুথবু হয়েই আমলা গ্রামে যাওয়া। আমলা সরকারি কলেজে তাঁরা থাকবেন এমনটাই কথা। কিন্তু মাঠে যাওয়ার পথেই চক্ষু চড়কগাছ। মাঠের পাশেই পুকুরে সাঁতার কাটছে কয়েকজন কিশোর-কিশোরী। তাদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন একজন প্রশিক্ষক। এমন সাঁতার-দৃশ্য দেখলেই তো শীতে শরীর কাঁপে। আর খুদে সাঁতারুরা সাঁতার কাটছে যেন আনন্দচিত্তে।

সাঁতারে এগিয়ে আমলার নারীরাও। পুকুরে নামার আগে চলছে অনুশীলন
সাঁতারে এগিয়ে আমলার নারীরাও। পুকুরে নামার আগে চলছে অনুশীলন

৯ জানুয়ারি এই খুদে সাঁতারুরা পাক্কা ৪০ মিনিট হিমশীতল পানিতে সাঁতরে চলে এল মাঠে। এরপর শুরু হলো শারীরিক কসরত। তাদের দলে যোগ দিল ছোট-বড় আরও কয়েকজন। এটা তাদের রোজকার রুটিন। কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম আমলার মানুষের কাছেও পরিচিত দৃশ্য।

পুকুরে সাঁতার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন কয়েকজন। ছবি: ছুটির দিনে
পুকুরে সাঁতার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন কয়েকজন। ছবি: ছুটির দিনে

এই গ্রামের নামেই ইউনিয়নের নাম আমলা। এ ইউনিয়ন এখন পরিচিত সাঁতারু তৈরির আঁতুড়ঘর হিসেবে। শুধু আমলা গ্রামেরই শতাধিক সাঁতারু এখন বিভিন্ন দলের হয়ে খেলছেন জাতীয় পর্যায়ে। এলাকার অনেক কিশোর-তরুণ গলায় পরেছে ১০-১৫টি জাতীয় পদক। সুমি খাতুন তাদেরই একজন। আমলা সদরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী সে। এরই মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে সোনাসহ ১৫টি পদক জয় করেছে। অন্যদের মতো প্রতিদিন স্কুল শুরু ও ছুটি শেষে সে সাঁতার প্রশিক্ষণ নিতে আসে।

সেদিন কলেজের মাঠেই কথা হলো সাঁতার প্রশিক্ষক, সংগঠক ও প্রশিক্ষণার্থী সাঁতারুদের সঙ্গে। প্রশিক্ষণার্থীরা শোনাল নানা কথা। তাদের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নেই, নেই সাঁতার সরঞ্জামও। অনেকে আসে গামছা পরে। এমন অনেক নেইয়ের মধ্যে তাদের আছে মনোবল, সামনে এগিয়ে চলার দৃষ্টান্ত আর অনুপ্রেরণা। সেসবই শোনা হলো তাদের কাছে।

‘জলকন্যা’ সবুরা খাতুন উঠে এসেছেন আমলা গ্রাম থেকে
‘জলকন্যা’ সবুরা খাতুন উঠে এসেছেন আমলা গ্রাম থেকে

এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা

একদিন যাঁরা এই আমলার খালে ও মজাপুকুরে সাঁতার শিখেছেন, তাঁদের অনেকেই আলো ছড়াচ্ছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। সে দলে আছেন নৌবাহিনীর রুবেল রানা, অনিক ইসলাম, আসিফ রেজা, নাজমা খাতুন, সীমা খাতুন, সুবর্ণা খাতুন। ‘জলকন্যা’ খ্যাত সাঁতারু সবুরা খাতুন। আছেন লাবণী আক্তার জুঁ্‌ই, লাবণী আক্তার, ববিতা খাতুন, জুয়েল আহমেদের মতো সাঁতারুরা। তাঁরা আছেন সেনাবাহিনীতে।

২০০৭ সালে ঢাকার মিরপুর জাতীয় সুইমিং কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠিত ২২তম জাতীয় বয়সভিত্তিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় এখানকার সাঁতারুদের ওপর নির্ভর করেই বাংলাদেশ আনসার-ভিডিপি ও বিজেএমসি পদক তালিকায় প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান লাভ করে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এখানকার সাঁতারুদের অবদান কম নয়। পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত নবম সাফ গেমসে আমলার সাঁতারু রুবেল রানা স্বর্ণপদক লাভ করেন।

২০০৯ সালের অক্টোবরে ঢাকার মিরপুর জাতীয় সুইমিংপুলে অনুষ্ঠিত জাতীয় বয়সভিত্তিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় এ অঞ্চলের সাঁতারুরা বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষে খেলে মোট ১৪টি জাতীয় রেকর্ডের মধ্যে ১৩ রেকর্ড গড়েন আর ৫০টি স্বর্ণপদকের মধ্যে ৪৭টি, ৪০টি রৌপ্য ও ২৭টি ব্রোঞ্জপদক পান। এর মধ্যে আমলার ববিতা খাতুন ২টি নতুন জাতীয় রেকর্ডসহ ১১টি স্বর্ণপদক পেয়ে বাংলাদেশ মহিলা সাঁতারুদের মধ্যে সেরা নির্বাচিত হন। আমলার আরেক কৃতী সাঁতারু জুয়েল রানা ৪টি নতুন জাতীয় রেকর্ডসহ ৯টি স্বর্ণপদক পেয়ে সারা দেশের পুরুষদের ইভেন্টে সেরা সাঁতারু নির্বাচিত হন। ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন রেকর্ডসহ এখানকার সাঁতারুরা অর্জন করেন ৫০টি স্বর্ণপদক।

সাঁতারে আমলার তরুণদের খ্যাতির এই গল্প এখানেই শেষ নয়। স্থানীয় সাঁতার প্রশিক্ষণ ক্লাব, প্রশিক্ষক ও কয়েকজন কৃতী সাঁতারুর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সাঁতারে কৃতিত্ব দেখিয়ে আমলা থেকে সেনাবাহিনীতে চাকরি পেয়েছেন ৪২ জন, আনসার-ভিডিপিতে ১৯ জন, নৌবাহিনীতে ১৫ জন, বিমানবাহিনীতে ৩ জন। বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান—বিকেএসপিতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে ১০ জন। সাঁতারে কৃতিত্বের সূত্র ধরে একটি উপজেলার একটি ইউনিয়ন থেকে এতজনের চাকরি পাওয়ার ঘটনা বিরল।

সাঁতারু রুবেল রানা নতুনদের অনুপ্রেরণা
সাঁতারু রুবেল রানা নতুনদের অনুপ্রেরণা

সাঁতারের পাঁচটি ক্লাব

আমীরুল ইসলামের হাতেই ১৯৮৬ সালে গড়ে ওঠে আমলা সুইমিং ক্লাব। এরপর সাফল্য বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে ক্লাবের সংখ্যা। সাগরখালী, লালন শাহ, গড়াই ও মেহেরপুর সুইমিং ক্লাব নামে আরও চারটি ক্লাব গড়ে উঠেছে আমলায়। এসব ক্লাবে প্রায় ২০০ জন সদস্য সাঁতার প্রশিক্ষণ নেন। যাঁর মধ্যে প্রায় ৬০ জন নারী। এই পাঁচটি ক্লাবই বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশনের অনুমোদন পেয়েছে। প্রশিক্ষণকাজে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ আনসার-ভিডিপি। কামাল হোসেন, মর্জিনা খাতুন, এমদাদুল হক ও আনোয়ার হোসেন ক্লাবগুলোতে সার্বক্ষণিক প্রশিক্ষক দেন। আর তাঁদের মাথায় ছায়ার মতো থাকেন আমীরুল ইসলাম।

সাগরখালী, লালন শাহ ও গড়াই সুইমিং ক্লাবে প্রশিক্ষক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রতিদিন দুই বেলায় ছেলেমেয়েরা প্রশিক্ষণ নিতে আসে। সাঁতার শিখতে আসে তাদের অনেকেই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। কেউ কেউ না খেয়েও সাঁতরাতে থাকে।’

ক্লাব থাকলেও তাঁদের নেই সুইমিংপুল। তাই পুকুর ও ডোবাই ভরসা। সাঁতারের কোচ মর্জিনা খাতুন বলেন, ‘পুকুরে সাঁতার প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকে আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবদান রাখছে। তাই আমলাতে একটা সুইমিংপুল হলে খুবই ভালো হয়।’ কোচ কামাল হোসেন বলেন, ‘আমলা গ্রামে ছোট আকারের হলেও একটি সুইমিংপুল থাকলে ছেলেমেয়েরা আরও উৎসাহ পেত।’

সাঁতারে জাতীয় রেকর্ড গড়া ববিতা খাতুন
সাঁতারে জাতীয় রেকর্ড গড়া ববিতা খাতুন

পিছিয়ে নেই নারী সাঁতারুরা

সাঁতারের কৃতিত্বে পিছিয়ে নেই আমলার নারীরাও। আমলার মেয়ে সবুরা খাতুন জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম সোনার পদক পান। তিনি বর্তমানে সেনাবাহিনীতে আছেন। এরপর ববিতা খাতুন ও চামেলী আক্তার সাঁতারে কৃতিত্ব দেখিয়ে আনসার-ভিডিপিতে চাকরি করছেন। নাজমা খাতুন, সীমা খাতুন, সুবর্ণা খাতুন, লাকী আক্তার নৌবাহিনীতে চাকরি করছেন। তাঁদের দেখেই কিশোরী-তরুণীরাও আসছেন সাঁতারে।

রোজকার প্রশিক্ষণে খুদে সাঁতারুরা
রোজকার প্রশিক্ষণে খুদে সাঁতারুরা

সাঁতারে স্বনির্ভর

এই এলাকার এত কিশোর-কিশোরী কেন সাঁতারে আগ্রহী? এই প্রশ্ন মাথায় খেলেছে শুরু থেকেই। জুতসই উত্তর মিলল আরও পরে। গ্রামের তরুণ-তরুণীরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলো ছড়ালেন আর এই সুবাদে তাঁদের চাকরি মিলল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, আনসার-ভিডিপি ও বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) সাঁতার দলে। খেলাধুলায় চাকরি মেলায় এখানকার অনেক অভিভাবক আগ্রহী হন। নিজেদের সন্তানকে তুলে দিচ্ছেন স্থানীয় সাঁতার প্রশিক্ষকদের হাতে। এমন একজন অভিভাবক নাজেরা খাতুন বলেন, ‘লেখাপড়া করে অনেকেই বেকার ঘুরে বেড়ায়। সেখানে পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলায় পারদর্শী হলে দ্রুত চাকরি পাওয়া যাচ্ছে। সে জন্যই আমার সন্তানদের সাঁতার প্রশিক্ষণে দিয়েছি।’

আমীরুল ইসলাম
আমীরুল ইসলাম

একজন আমীরুল ইসলাম

১৯৮৪ সালের কথা। আমীরুল ইসলাম তখন স্থানীয় নওদা আজমপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্রীড়াশিক্ষক। ক্লাস নেন আর ভাবেন এবার তাঁর কাজে নামার সময় হয়েছে। সেই যে ছোটবেলায় পুষে রাখা আক্ষেপটা আবার নতুন মাত্রা পেল। আক্ষেপটা কী? আমীরুল ইসলাম বলেন, ‘স্কুলে পড়ার সময় একবার জেলায় সেরা সাঁতারু হয়েছিলাম। কিন্তু বিভাগীয় পর্যায়ে গিয়ে ছিটকে পড়ি। খুব খারাপ লেগেছিল তখন।’

আমলা গ্রামের আমীরুল ইসলাম অন্য খেলাধুলায় এগিয়ে ছিলেন ছোটবেলা থেকেই। তবে সাঁতারে এগোতে পারেননি। সেই খারাপ লাগা থেকেই তিনি উদ্যোগী হলেন এলাকার ছেলেমেয়েদের সাঁতার শেখাতে। শুরুতে পেয়েছিলেন ১০-১২ জন ছেলেকে। তাঁদের নিয়ে পাশের খালে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। তাঁর মুখ উজ্জ্বল হতে বেশি দিন লাগেনি। ১৯৯১ সালে সেই দলের রমজান আলী ও মনিরুল ইসলাম প্রথম জাতীয় পর্যায় থেকে সোনা বয়ে আনেন। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে তাঁর হাতে তৈরি হন মমতাজ শিরীন, সবুরা খাতুন, রুবেল রানা, রুবেল আহমেদ, জুয়েল আহমেদ, ববিতা খাতুন, পাপিয়া খাতুন, চামেলী আক্তার, সুমাইয়া খাতুন, আরিফা খাতুন, আলামিন রাজিব, সুমি, লাকীসহ জাতীয় পর্যায়ে সোনা জয়ী সাঁতারুদের আরও অনেকেই।

গ্রামের মানুষের সহযোগিতা বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে সাঁতারে আগ্রহী তরুণের সংখ্যা। আমীরুল ইসলাম বর্তমানে বাংলাদেশ আনসার-ভিডিপির সাঁতার দলের কোচ। একসময় দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও। তিনি বলেন, ‘সাঁতার আমলাকে দেশের মানুষের কাছে চিনিয়েছে। দেশের সেরা সাঁতারুদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি সাঁতারু আমলা থেকেই তৈরি হয়। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী-বা হতে পারে।’