তদন্তে প্রমাণিত, দুই মাসেও শাস্তি হয়নি

রাজশাহী মহানগর পুলিশের আট সদস্যের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে তদন্ত হয়েছে। তদন্তে সবার বিরুদ্ধেই অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু প্রতিবেদন জমা দেওয়ার দুই মাসেও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

পুলিশের ডিসিপ্লিন অ্যান্ড প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড (ডিএনপিএস) বিভাগ তদন্ত করে গত ২০ নভেম্বর সদর দপ্তরে ওই প্রতিবেদন দাখিল করে। কিন্তু ওই আটজনের সাতজনই ইতিমধ্যে বদলি নিয়ে চলে গেছেন। একজন এখনো বহাল তবিয়তে আগের থানায়ই আছেন।

ওই পুলিশ সদস্যরা হচ্ছেন উপপরিদর্শক (এসআই) ইফতেখার, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মাসুদ ইকবাল, সেলিম খান, মোর্শেদ, আবদুল মালেক ও মুজাহিদুর রহমান এবং কনস্টেবল মনিরুল ইসলাম ও আসেক আহাম্মেদ। মুজাহিদুর ছাড়া সবাই অপরাধ সংঘটনের সময় নগরের রাজপাড়া থানায় ছিলেন। মুজাহিদুর তখনো কেশবপুর ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। এরপরও তিনি একই পদে বহাল আছেন।

তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, গত ২৯ মে কেশবপুর ফাঁড়ির একটি টহল দল মাদকসহ একজনকে ধরে আনে। তাঁকে ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসআই মুজাহিদুরের কাছে জমা দিয়ে দলের সদস্যরা বাইরে যান। পরে ফিরে এসে দেখেন, আসামিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তদন্তে মুজাহিদুরের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। এখনো তিনি ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে বহাল আছেন।

গত ৩০ মে রাজপাড়া থানার এএসআই মাসুদ ইকবাল নগরের বাকির মোড় এলাকার একজন আত্মসমর্পণকারী মাদক ব্যবসায়ীর বাড়িতে গিয়ে কিছু না পেয়েও ওসির হুকুমে ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে হুমকি দেন। তিনি ওই ব্যক্তির কাছ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা নেন। একই দিন দিবাগত রাত তিনটার দিকে তিনি সাদাপোশাকে নগরের বাগানপাড়া এলাকার আত্মসমর্পণকারী আরেক মাদক ব্যবসায়ীর বাড়িতে অভিযান চালান। তিনি ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মাদক রাখার অভিযোগ তোলেন। এ সময় তিনি থানার অপর এএসআই সেলিমকে ডেকে নেন। তাঁরা ওই ব্যক্তির কাছ থেকে ৬৫ হাজার টাকা আদায় করেন।

এএসআই আবদুল মালেক নগরের গুড়িপাড়া থেকে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতেন। তদন্তে তিনি ছাড়া এসআই ইফতেখার, সেলিম খান, এএসআই মোর্শেদ ও কনস্টেবল মনিরুলের বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়।

২০১৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর এসআই ইফতেখার ও এএসআই মোর্শেদ গুড়িপাড়ার এক মাদক ব্যবসায়ীর ছেলেকে পদ্মা নদীর তীরে মাদকসহ আটক করেন। পরে সেখানে কনস্টেবল মনিরুল ইসলাম যান। পরে মনিরুলের ফোন থেকে আটক ব্যক্তি তাঁর মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। ওই ব্যক্তিকে মাদক আইনের আওতার বাইরে অন্য ধারায় চালান দেওয়া হয়। একই বছরের ১৮ ডিসেম্বর গুড়িপাড়া এলাকার আরেক মাদক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মনিরুলের মাধ্যমে টাকা আদায় করা হয়। এ টাকার ভাগ পেয়েছেন ইফতেখার ও মোর্শেদ।

এসব ঘটনা নিয়ে গত ৮ অক্টোবর প্রথম আলোয় ‘পুলিশের “ভালো” কাজে পুলিশেরই বাধা’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর পুলিশের ডিএনপিএস এর তদন্ত শুরু করে।

কনস্টেবল আসেক আহাম্মেদ রাজপাড়া থানায় থাকাকালে গত ২৯ সেপ্টেম্বর থানায় ইয়াবাসহ একজন আসামি ধরা হয়। আলামত কোথায় রাখা হয়েছিল, তা আসেক আহাম্মেদ জানতে পেরেছিলেন। সুযোগ বুঝে তিনি আলামত সরিয়ে ফেলেন। পরে ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন (সিসিটিভি) ক্যামেরার ফুটেজে আসেক আহাম্মেদকে আলামত সরাতে দেখা যায়। এরপর তাঁকে রাজপাড়া থানা থেকে পুলিশ লাইনসে প্রত্যাহার করা হয়।

পুলিশের ডিএনপিএস বিভাগ এসব ঘটনার তদন্ত করে অভিযোগের প্রমাণ পায়। গত ২০ নভেম্বর তারা এ তদন্ত প্রতিবেদন সদর দপ্তরে দাখিল করে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, দোষী এসব পুলিশ সদস্যের শাস্তি তো হয়ইনি, উল্টো তাঁদের সাতজনই ‘মাদক-রুটে’ বদলি হয়েছেন। একজন বহাল তবিয়তে রয়েছেন আগের কর্মস্থলেই।

মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা যায়, এসআই মোর্শেদ ঘটনার পরপরই বদলি হয়ে চট্টগ্রাম চলে যান। এএসআই মাসুদ ইকবাল বদলি নিয়ে রাজশাহী মহানগরের পাশের পবা থানায় রয়েছেন। এসআই ইফতেখারকে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) বদলি করা হলেও তিনি সেখানে যোগ দেওয়ার পরই রাজশাহী রেঞ্জে ফিরে এসেছেন। কনস্টেবল মনিরুল ইসলাম বদলি হয়ে নওগাঁর মান্দা থানায় গেছেন। এএসআই সেলিম খান গেছেন নাটোর সদর থানায়। আর এএসআই আবদুল মালেককে অন্য একটি ঘটনায় পুলিশ লাইনসে প্রত্যাহার করা হলেও পরে নগরের শাহ মখদুম থানায় বদলি করা হয়।

জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার ইফতে খায়ের আলম প্রথম আলোকে বলেন, এসব ঘটনায় তদন্ত হয়েছে। সদর দপ্তর থেকে শাস্তি হওয়ার কথা। কী শাস্তি হয়েছে, তা তাঁর জানা নেই।