বাংলাদেশ এখন মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুয়ায়ী, গত বছর দেশে ৪১ দশমিক ৩৪ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুয়ায়ী, গত বছর দেশে ৪১ দশমিক ৩৪ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়েছে।

দেশে আবারও সুদিন ফিরেছে মাছের। দেশের বিজ্ঞানীদের গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন জাতের মাছ চাষে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, স্বাধীনতার পর এই প্রথম বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুয়ায়ী, গত বছর দেশে ৪১ দশমিক ৩৪ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়েছে।

মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, সম্প্রতি বাংলাদেশকে মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ ঘোষণা করেছে মৎস্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তর থেকে পাঠানো এক চিঠিতে বিষয়টি উল্লেখ করে তা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

মৎস্য ও প্রাণী সম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি, এটা গোটা জাতির জন্য অনেক বড় অর্জন। আমরা এখনো এটা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করিনি। তবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে শিগগিরই এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হবে।’
মন্ত্রী বলেন, মাছ আমাদের আমিষের চাহিদা পূরণে অনেক বড় ভূমিকা রাখছে। এই স্বয়ংসম্পূর্ণতা বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে আরও উজ্জ্বল করবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার কী কী কারণ, তা জানতে চাইলে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ বলেন, ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে মাছের মোট উৎপাদন ছিল ৭ দশমিক ৫৪ লাখ মেট্রিক টন। ৩৩ বছরের ব্যবধানে ২০১৬-১৭ সালে এই উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৪১ দশমিক ৩৪ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ, এই সময়ের ব্যবধানে মোট মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ। সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের কারণেই এই উৎপাদন বৃদ্ধি।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ১৯৯০ সালে দেশে মোট চাষকৃত মাছ উৎপাদিত হয়েছিল ১ লাখ ৯৩ হাজার টন। ২০০০ সালে তা বেড়ে হয় ৬ লাখ ৫৭ হাজার টন। গত বছর মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৫০ লাখ মেট্রিক টন। মাছ উৎপাদন হয়েছে ৪১ দশমিক ৩৪ লাখ মেট্রিক টন।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে অন্যতম ভূমিকা ইলিশ মাছের। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদিত হয়। সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৯৬ হাজার বা প্রায় ৫ লাখ মেট্রিক টন। অধিদপ্তরের হিসাবে, গত অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশই ছিল ইলিশ।

ইলিশের উৎপাদন বাড়ার কারণ হিসেবে মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, কয়েক বছর ধরে ইলিশ রক্ষায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, কোস্টগার্ড, পুলিশ ও নৌবাহিনী সমন্বিতভাবে কাজ করছে। সবার সহায়তায় বিশেষ অভিযানও পরিচালনা করা হয়। তাতে জাটকা সংরক্ষণ ও মা ইলিশ রক্ষা পায়। এ কারণেই ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের মানুষের মাছ খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। আগে জনপ্রতি প্রতিদিন গড়ে ৬০ গ্রাম মাছ খেত, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬২ দশমিক ৫৮ গ্রাম।

মৎস্য অধিদপ্তর জানায়, ময়মনসিংহ, বগুড়া ও কুমিল্লা জেলায় পুকুরে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে ঘেরে মাছের চাষ রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছে। বিপন্নপ্রায় মাছের প্রজাতির সংরক্ষণ, অবাধ প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি হয়েছে। গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন নদ-নদী ও অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে ৫৩৪টি মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপন করা হয়েছে। অভয়াশ্রম-সংশ্লিষ্ট জলাশয়ে মাছের উৎপাদন ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি হয়েছে। অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার ফলে বিলুপ্তপ্রায় এবং বিপন্ন ও দুর্লভ প্রজাতির মাছ, যথা একঠোঁট, টেরিপুঁটি, মেনি, রানী, গোড়া গুতুম, চিতল, ফলি, বামোস, কালিবাউশ, আইড়, টেংরা, সরপুঁটি, মধু পাবদা, রিঠা, কাজলি, চাকা, গজার, বাইম ইত্যাদির তাৎপর্যপূর্ণ পুনরাবির্ভাব ও প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অভয়াশ্রমে দেশি কই, শিং, মাগুর, পাবদা ইত্যাদি মাছের পোনা ছাড়ার ফলে এসব মাছের প্রাচুর্যও বৃদ্ধি পেয়েছে।

মৎস্য ও মৎস্যজাত দ্রব্য বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য। ২০১৬-১৭ সালে ৬৮৩০৫ দশমিক ৬৮ মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে ৪ হাজার ২৮৭ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে।

মৎস্য অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শেখ মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গত কয়েক দশকে দেশে চাষ করা মাছে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে। শিং, মাগুর, পাবদার মতো আরও বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছ হারিয়ে যেতে বসেছিল। গবেষণার মাধ্যমে এই জাতের মাছ এখন চাষ হচ্ছে। চাষ করা মাছ থেকে প্রায় ৬০ শতাংশ উৎপাদন হয়। সাগরে মাছ ধরার নতুন নতুন সরঞ্জাম কেনা হলে মাছ উৎপাদন বেড়ে যাবে। ওই সব যন্ত্রের মাধ্যমে কোন এলাকায় বেশি মাছ আছে তা নিশ্চিত হওয়া গেলে সাগর থেকে মৎস্য আহরণ আরও বেড়ে যাবে। তাতে সার্বিকভাবে মৎস্য উৎপাদন আরও বাড়বে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ডফিশের ইকোফিশের টিম লিডার আবদুল ওহাব বলেন, দেশে বিপুল পরিমাণ পাঙাশ, তেলাপিয়া ও রুইজাতীয় মাছের উৎপাদন বেড়েছে। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, চীনের উদ্ভাবিত মাছের জাত এখন বাংলাদেশের মৎস্য উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছে। মাছের উৎপাদন বাড়ার কিছু কারণ ব্যাখ্যা করলেন আবদুল ওহাব। তিনি বলেন, শিক্ষিত তরুণেরা চাকরির দিকে না ঝুঁকে মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। এ ছাড়া ব্যাংকগুলো মাছ ও কৃষিকাজে সহজ শর্তে ঋণ দিয়েছে। এতে মাছের দিকে মানুষ ঝুঁকেছে। বাজারে মাছের ব্যাপক চাহিদাও মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তিনি।


মাছ আমদানির চিত্র
মাছের দেশ বাংলাদেশ হলেও এই দেশে এখনো মাছ আমদানি করা হচ্ছে। তবে সেই আমদানি কমছে। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭৮ হাজার টন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রায় ৮৮ হাজার টন মাছ আমদানি করা হয়।
গেল বছরে মাছের আমদানি কমে যাওয়ার কারণ জানালেন বাংলাদেশ মৎস্য আমদানিকারক সমিতির সভাপতি আশরাফ হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেশে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে এ বছর আমদানি অনেক কমে গেছে। এ ছাড়া আমদানি কমার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে নতুন একটি নিয়ম। আগে চট্টগ্রামেই মাছ পরীক্ষার পর তা বাজারজাত করা যেত। নতুন নিয়ম অনুসারে আমদানি করা মাছ ঢাকায় পরীক্ষা করার পর বাজারজাত করতে হবে। কিন্তু এটা অনেক সময় সাপেক্ষ। তাই আমদানিকারকেরা মাছ আমদানিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।

দেশে প্রতিবছর যত মাছ আমদানি হচ্ছে, তার একটি বড় অংশই হলো সামুদ্রিক মাছ। মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, এই মাছের মধ্যে আছে সি ক্যাট ফিশ (মাগুর, শিংসহ অন্যান্য), রূপচাঁদা, সেড বা গিজার্ড সেড, সার্ডিন প্রভৃতি। এসব সামুদ্রিক মাছ আমদানি হচ্ছে মিয়ানমার, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম থেকে।

মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শ্রিম্প অ্যান্ড ফিশ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহমুদুল হক বলেন, মাছের উৎপাদন বেড়েছে এটা ঠিক, কিন্তু আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে। এখনো আমাদের দেশে মাছ আমদানি করতে হচ্ছে। এটার অন্যতম কারণ হচ্ছে দেশে জনসংখ্যা বেড়েছে। অন্য কারণ হচ্ছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। এ দুই কারণে মাছ আমদানি হচ্ছে। তবে মাছের উৎপাদন আরও বাড়লে এই পরনির্ভরশীলতা কমবে বলে মনে করেন তিনি।