‍প্রত্যাবাসন নিয়ে বিভ্রান্তি রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভ

২৩ জানুয়ারি প্রত্যাবাসন শুরু হবে কি হবে না, এ নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যেই আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গারা গতকাল রোববার আবারও বিক্ষোভ করেছে। তারা বলছে, নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, নিজ জমিতে ফেরার নিশ্চয়তাসহ ৮ দফা না মানলে তারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে না। এসব দাবিতে তারা আরাকান রোহিঙ্গা হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস সোসাইটি নামে অনানুষ্ঠানিক কার্যক্রমও শুরু করেছে।

বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত সূত্রগুলো বলছে, ২৩ জানুয়ারি প্রত্যাবাসন শুরুর যে কথা মিয়ানমার প্রচার করছে, এটা বিভ্রান্তিমূলক। বাংলাদেশের সঙ্গে ওই দেশের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়েছে। পরিবারভিত্তিক তালিকা তৈরির কাজ চলছে। এটা শেষ করতে আরও ২-৩ সপ্তাহ লাগতে পারে। অবশ্য রোহিঙ্গা আসা বন্ধ হয়নি। গত ২৩ নভেম্বরে প্রত্যাবাসন চুক্তি হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২৫ হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে এসেছে।

সব প্রস্তুতি শেষ করে প্রত্যাবাসন শুরু করতে ৩ থেকে ৪ মাস বা আরও বেশিও সময় লাগতে পারে বলে মনে করছেন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী, দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া শুরু করার কথা। ইতিমধ্যে সেটা শুরু করেছি। ২৩ জানুয়ারি রোহিঙ্গাদের পাঠানো শুরুর কথা বলে মিয়ানমার বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।’

মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, ‘প্রত্যাবাসনের প্রথম কাজ হচ্ছে রূপরেখা তৈরি, এটা করা হয়েছে। এরপর প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত কাজ। তারপর ফেরত পাঠানো।’ তিনি বলেন, নিরাপদ ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের অনেকগুলা করণীয় আছে। এসব কাজের জন্য সময় দিতে হবে, যার বেশির ভাগ মিয়ানমারের করণীয়। ট্রানজিট ক্যাম্প করতে হবে। পাঁচটি ট্রানজিট ক্যাম্প করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অন্তত দুটি দ্রুত করতে হবে।

জানা গেছে, দুটি ট্রানজিট ক্যাম্পের জন্য প্রাথমিকভাবে জায়গা ঠিক করা হয়েছে। একটি টেকনাফ নয়াপাড়া বন্দরে, সেখানে এখন আনসার ক্যাম্প আছে। এটা নদীপথের জন্য। অপরটি নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, স্থলপথের জন্য।

নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চায় রোহিঙ্গারা

গতকাল উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং বিভিন্ন বয়সের রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২৩ জানুয়ারি প্রত্যাবাসন শুরু হবে কি হবে না, এ নিয়ে তারা বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে গতকাল সকাল নয়টার দিকে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-৪ ব্লকে আইওএম চিকিৎসাশিবিরের কাছে ইংরেজিতে ৮ দফা দাবি লেখা ব্যানার নিয়ে কিছু রোহিঙ্গা মিছিল করে। তারা তাদের ভাষায় স্লোগান দেয়। গত বছর ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই উখিয়ার কুতুপালং এলাকায় আশ্রয়শিবিরে রয়েছে।

ব্যানারের পেছনে শ দুয়েক লোক থাকলেও এর আশপাশে আরও কয়েক শ রোহিঙ্গা জড়ো হয়। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে পরে তারা এই প্রতিবেদককে জানায়, তারাও এসব দাবিতে এককাট্টা। তারা আধা ঘণ্টার মতো সেখানে বিক্ষোভ করে।

শুরুতে জ্যেষ্ঠ এক ব্যক্তি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করেন। তাতে তিনি ৮ দফা দাবি তুলে ধরেন। এক. ফেরত পাঠানোর আগে মিয়ানমারে তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেখানে জাতিসংঘ বাহিনী মোতায়েন, দুই. রোহিঙ্গা পরিচয়ে তাঁদের নাগরিকত্ব, তিন. নিজ বাড়ি, জমি ও গ্রামে ফেরার নিশ্চয়তা, চার. মিয়ানমারের অন্য জাতিগোষ্ঠীর মতো সমান মর্যাদা দেওয়া, পাঁচ. ক্ষতিপূরণ, ছয়. হত্যা, ধর্ষণ ও জাতিগত নিধনের বিচার, সাত. আগের কোনো ঘটনায় প্রত্যাগতদের না ফাঁসানোর নিশ্চয়তা এবং আট. প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘ, এইচআরডব্লিউ, ইইউ ও রোহিঙ্গা প্রতিনিধি যুক্ত করা। রোহিঙ্গারা বলছে, এসব দাবি না মানলে তারা যাবে না।

পরে জানা গেছে, এসব দাবিতে এটাই প্রথম বিক্ষোভ নয়। তারা প্রথম বিক্ষোভ করে গত ৯ ডিসেম্বর, লাম্বাসিয়ায়। এরপর ১১ ডিসেম্বর, কুতুপালং বি ব্লকে। রোহিঙ্গা জাতিসত্তার স্বীকৃতির দাবিতে ৬ জানুয়ারি তারা ছোট পরিসরে ‘রোহিঙ্গা ন্যাশনাল ডে’পালন করে। ১৯ জানুয়ারি তারা সকাল আটটা ও বেলা আড়াইটায় দুই দফা দুটি ব্লকে বিক্ষোভ করে।

কারা এই বিক্ষোভ সংগঠিত করেছে—এ নিয়ে গতকাল কথা হয় কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে। তাঁরা তাঁদের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি, পরে হয়রানির শিকার হন কি না, এ আশঙ্কায়।

জানা গেল, এরই মধ্যে ‘আরাকান রোহিঙ্গা হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস সোসাইটি’ নামে তারা সংঘের মতো তৈরি করেছে। তারা অনানুষ্ঠানিক কিছু কার্যক্রমও শুরু করেছে। একেবারে সাধারণ রোহিঙ্গারা এই নামের সঙ্গে খুব পরিচিত নয়। তবে এর সঙ্গে বিভিন্ন ক্যাম্পের মুরব্বি বা নেতৃস্থানীয় অনেকে যুক্ত। তাঁদের কাজের সমন্বয় করেন ১৩ জন। এমন একজনের সঙ্গে গতকাল কুতুপালং বাজারে কথা হয়। তিনি বলেন, তাঁদের মূল লক্ষ্য সন্ত্রাস-সহিংসতাবিরোধী সচেতনতা তৈরি। তাঁরা মিয়ানমারে তাঁদের ওপর সহিংসতার তথ্য সংগ্রহ করছেন। এর বাইরে ৮ দফা দাবির সমর্থনে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান করেছেন। প্রায় ২০ হাজার স্বাক্ষরসহ তা ৫ জানুয়ারি ক্যাম্প ইনচাজর্কে দিয়েছেন।

এসব কাজের সমন্বয়কদের একজন মো. মহিবুল্লাহ। বিক্ষোভ কারা সংগঠিত করেছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারও সংগঠিত করা লাগছে না। ওখানে নিয়ে আবার ক্যাম্পে রাখলে কেউ যাবে না। তিনি বলেন, এখনো রাখাইন থেকে লোক আসছে, সেখানে নিরাপদ পরিস্থিতি হলে এখন তো আর কেউ আসত না।

মহিবুল্লাহ জানালেন, গত পরশু (শুক্রবার) রাচিডং থেকে ৪২ পরিবার এসেছে। তাদের বালুখালীতে রাখা হয়েছে। আরও অনেকে আসার অপেক্ষায় আছে সীমান্তের কাছে। মিয়ানমারের সেনা টহল ও নৌকা-সংকটের কারণে ঢুকতে পারছে না। এরা আসছে বুচিডং সিন্দিপিন থেকে।

এ সময় জড়ো হন সফিকুল ইসলাম, ছৈয়দ কবীর, নুর কবীর, জমির হোসেন, আমির হোসেনসহ অনেকে। তাঁরা রাখাইনের বুচিডং, রাচিডং ও মংডুর বাসিন্দা। তাঁরা বলেন, ‘আমাদের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, জমিজমা ফেরত দিলে যেভাবে এসেছি, সেভাবে ফিরে যাব।’

সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ আমির হোসেন বলেন, ‘বার্মার (মিয়ানমার) বিশ্বাস নাই। ওরা মোনাফেক। তারা আইকাব ক্যাম্পে (২০১২ সালে দাঙ্গায় বাস্তুচ্যুত হওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য রাখাইনে শরণার্থী ক্যাম্প) যারা আছে, তাদের আগে নাগরিকত্ব দিক। তারপর আমরা যাব। আমরা আবার খুপরিতে ঢুকতে চাই না।’

রোহিঙ্গাদের নিয়ে শুরু থেকে পর্যবেক্ষণ করছেন মানবাধিকারকর্মী মো. নূর খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গারা যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দেশ ত্যাগ করেছে, স্বাভাবিকভাবে ভীতি তাদের পিছু ছাড়ছে না। তাই তারা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চাইবে, ঘটে যাওয়া ঘটনার বিচার চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। তাদের যদি নিশ্চয়তা না দেওয়া হয়, তারা বেঁকে বসতে পারে, যা নতুন পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।