আ.লীগের সহসম্পাদক পদ 'গলার কাঁটা'

বঞ্চিতদের ক্ষোভ অব্যাহত 

সহসম্পাদক পদ পূরণে গঠনতন্ত্র মানা হয় না 

কমিটিতে ঢোকা ছাড়া এ পদের কার্যকারিতা নেই

সহসম্পাদক পদে নিয়োগে গঠনতন্ত্র অনুসরণের চর্চা না থাকায় এ পদগুলো এখন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের জন্য ‘গলার কাঁটায়’ পরিণত হয়েছে। বঞ্চিত নেতাদের কমিটিতে ঢোকার পথ করে দেওয়া ছাড়া এই পদগুলোর এখন আর খুব একটা কার্যকারিতা নেই।

এবার এ পদ নিয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের ক্ষোভ থামছেই না। গতকাল রোববারও আওয়ামী লীগের ধানমন্ডির নির্বাচনী কার্যালয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সামনে বিক্ষোভ দেখান কিছু সাবেক ছাত্রনেতা। পরে ওবায়দুল কাদেরের আশ্বাস পেয়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্রনেতারা বেরিয়ে আসেন।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সহসম্পাদক পদটি একটি ‘স্পর্শকাতর’ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অতীতে দলের গঠনতন্ত্র মেনে সহসম্পাদক নিয়োগ করা হয়নি। এ জন্য সহসম্পাদকের অনেকের বিরুদ্ধে তদবির, ভিজিটিং কার্ড তৈরি করে নিজ এলাকায় হুমকি-ধমকি দেওয়া, এমনকি চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠে। এ জন্য এবার সহসম্পাদকের সংখ্যা কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় দলের কার্যনির্বাহী কমিটি।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে প্রতিটি বিষয়ভিত্তিক সম্পাদকীয় পদের অধীনে একটি করে উপকমিটি থাকবে। প্রতিটি উপকমিটির সভাপতি আগেই ঘোষণা করা হয়েছে এবং তা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়েছে। গঠনতন্ত্র অনুসারে উপকমিটির সদস্যসচিব হবেন ওই বিভাগের সম্পাদক। বাকিরা সহসম্পাদক ও সদস্য। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে উপকমিটির কাজ হিসেবে বলা হয়েছে, এই কমিটি তথ্য, উপাত্ত ও পরিসংখ্যান সংগ্রহ ছাড়াও সময়-সময় নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করবে। প্রতি তিন মাসে একবার করে সভায় বসবে। স্ব স্ব কমিটি তাদের কাজের মূল্যায়ন করবে এবং করণীয় ঠিক করবে। তবে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া উপকমিটিগুলো তথ্য, উপাত্ত সংগ্রহ দূরে থাক, বৈঠকই করে না বলে দলীয় সূত্র জানায়।

গত বুধবার থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আওয়ামী লীগের উপকমিটির সহসম্পাদক-সদস্য হিসেবে প্রায় ৬০০ নামের তালিকা প্রচার হতে থাকে। তালিকায় নাম থাকারা ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে তা উদ্‌যাপন করেন। আর বঞ্চিতরা সংগঠিত হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ শুরু করেন। পরে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গণমাধ্যমকে জানান, প্রচারিত তালিকাটি চূড়ান্ত নয়।

শনিবার ধানমন্ডির নির্বাচনী কার্যালয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখায় বঞ্চিতরা। পরে অবশ্য আশ্বাসের ভিত্তিতে ছাত্রনেতারা শান্ত হন। কিন্তু গতকাল পুনরায় তাঁরা বিক্ষোভ করেন। বঞ্চিতদের অভিযোগ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সহসম্পাদকের তালিকা দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান তৈরি করেন। এ জন্য তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ তাঁরা। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার থেকে আবদুস সোবহান দপ্তরে বসছেন না। তিনি গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরে গেছেন বলে দলীয় নেতারা জানান।

শনিবারের বিক্ষোভের পর রোববার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে সহসম্পাদকদের ক্ষোভ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের সমালোচনা করেন ওবায়দুল কাদের। তিনি দাবি করেন, সহসম্পাদকের পদবঞ্চিত ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের আওয়ামী লীগের ধানমন্ডির নির্বাচনী কার্যালয়ে বিক্ষোভ করেননি। আনন্দ মিছিল করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের দুজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, সহসম্পাদক নিয়োগের ক্ষেত্রে কখনোই গঠনতন্ত্র মানা হয়নি। সে জন্য গঠনতন্ত্রে যে কাজের কথা বলা হয়েছে, সহসম্পাদকেরা কেউ তা মানেননি। গঠনতন্ত্রে ১৯টি সম্পাদকীয় পদের অধীনে সর্বোচ্চ পাঁচজন সহসম্পাদক নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। অতীতে তা মানা হয়নি। এবার সহসম্পাদক কমিয়ে উপকমিটিগুলোর সদস্য বৃদ্ধির কৌশল নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আটজন সাংগঠনিক সম্পাদকের অধীনেও সহসম্পাদক রাখা হচ্ছে, যা গঠনতন্ত্রে নেই।

সহসম্পাদক পদের প্রতি এত আগ্রহ কেন?

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানায়, ২০১২ সালে গঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অধীনে যে উপকমিটি হয়েছিল, তাতে প্রথমে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ৬৬ জনকে সহসম্পাদক করেছিলেন। এদের প্রায় সবাই ছাত্রলীগে গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন এবং বয়সের কারণে ছাত্ররাজনীতি ছাড়তে হয়েছে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, ৬৬ জনের পর আরও প্রায় ৪৫০ সহসম্পাদক করা হয়। ২০১৩ সালের দিকে অনানুষ্ঠানিকভাবে আরও সহসম্পাদক নিয়োগ করা হয়। তখন দলে একটা আলোচনা ছিল আওয়ামী লীগে সহসম্পাদকের সংখ্যা কত তা কেউ জানে না।

দলীয় সূত্র জানায়, সহসম্পাদকের পদটাকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রবেশের প্রাথমিক দরজা মনে করা হয়। আগের কমিটির শুরুর ৬৬ জনের তালিকা থেকে অনেকে গত বছর কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পেয়ে যান। কিন্তু গত বুধবার থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সদস্য-সহসম্পাদকের যে তালিকা ছড়িয়ে পড়ে, তাতে ছাত্রলীগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাবেক নেতা বাদ পড়েন। এমনকি ওই ৬৬ জনেরও অনেকের স্থান হয়নি এতে। এরপরই ছাত্রলীগের বিগত কয়েকটি কমিটির বঞ্চিত নেতারা এক হয়ে প্রতিবাদে শামিল হন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া তালিকায় দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহানের নাম ছিল। তবে বৃহস্পতিবার থেকেই তিনি দপ্তরে নেই। তিনি নিজ জেলা মাদারীপুরে গেছেন বলে দলীয় সূত্র জানায়। শনিবার ওবায়দুল কাদের নির্বাচনী কার্যালয়ে গেলে তাঁকে উদ্দেশ করে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয় তাঁর ওপর।

গতকাল বিক্ষুব্ধ ছয়জন নেতার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা জানান, ছাত্রদলের সাবেক নেতা, গৃহিণী, জেলা বা অন্য কমিটিতে রয়েছেন এমন ব্যক্তিদের নামও তালিকায় আছে। অর্থের বিনিময়ে সহসম্পাদক পদ দেওয়া হচ্ছে বলেও তাঁরা অভিযোগ করেন। নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্তি ছাড়াও দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা যাতে বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেন, এটাও তাদের লক্ষ্য।

গঠনতন্ত্রে উপকমিটি গঠনের ক্ষমতা দেওয়া আছে দলীয় প্রধানকে। সহসম্পাদক হিসেবে যাঁদের নাম এসেছে, তাঁদের অনেককেই বিভাগীয় সম্পাদকেরা চিনতে পারছেন না। ফলে সম্পাদকমণ্ডলীর নেতাদের মধ্যেও অসন্তোষ আছে। সহসম্পাদক নিয়ে এই সমালোচনায় দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাও বিরক্ত হয়েছেন বলে দলীয় সূত্র জানায়।

সাধারণ সম্পাদকের দাবি

গতকাল রোববার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে গণমাধ্যমে আসা খবরের সমালোচনা করে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তখন তারা আনন্দ মিছিল করছিল। আর এটাকে বলে বিক্ষোভ মিছিল! সেক্রেটারিকে নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল! এটা অন্যায়, এটা কষ্টকর।’

শনিবার সন্ধ্যায় ধানমন্ডির নির্বাচনী কার্যালয়ে ছাত্রলীগের শতাধিক সাবেক নেতা-কর্মী উপস্থিত হয়ে ওবায়দুল কাদেরের নাম ধরে হইচই করতে থাকেন। সহসম্পাদকের তালিকায় নিজেদের নাম না থাকায় তাঁরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এরপর ওবায়দুল কাদের বেরিয়ে এসে দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেন।

গতকালের সংবাদ সম্মেলনে গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়া খবরের কথা উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘লিখেছে, গতকাল বিক্ষোভ করেছে, কাদের সাহেবকে কনফাইন করছে...আমি তো এসব দেখলাম না। আমি তো নামাজ পড়ছিলাম। তখন দরজা বন্ধ ছিল। অজু করে আমি নামাজ পড়ি, হাট করে দরজা খুলে দেব? খুব কষ্ট পেয়েছি, বিশ্বাস করেন।’ তিনি বলেন, যাঁরা তাঁর কাছে গিয়েছিলেন, তাঁদের তিনি উপকমিটি নিয়ে সঠিক তথ্য দেওয়ার পর তাঁরা আনন্দ প্রকাশ করেছেন, বিক্ষোভ নয়। তাঁদের কাছে যখন বিষয়টা পরিষ্কার হয়েছে, তখন তাঁরা আনন্দ মিছিল করছিলেন।

ওই ঘটনার সময় সাংবাদিকেরা উপস্থিত ছিলেন না দাবি করে কাদের বলেন, ‘তাহলে তারা শুনে লিখেছে। শুনে কেন লিখবে? এটা তো বিক্ষোভ না, আনন্দ মিছিল করেছে। ফেসবুকে যা বেরিয়েছে তা নিয়ে জানতে গেছে। পরে খুশি হয়ে তারা আনন্দ মিছিল করেছে।’

ওবায়দুল কাদের কমিটির তালিকার ব্যাখ্যা করে বলেন, এবার সমস্যার মূল কারণ যাদের উপকমিটিগুলো চূড়ান্ত হয়নি, সেই সম্পাদকদের কাছে অফিস সেক্রেটারির স্বাক্ষরে খসড়া কমিটি পাঠানো হয়েছিল। সেটি ফেসবুকে প্রচার হওয়ার কারণে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।