প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ এখনো অজানা

রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে ঠিক দুই মাস আগে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি সই করেছিল মিয়ানমার। চুক্তি সইয়ের দুই মাসের মধ্যে ‘প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া’ শুরুর কথা। কিন্তু প্রত্যাবাসন কবে শুরু হবে, তা কেউ নিশ্চিত করতে পারছে না। দিনক্ষণ এখনো অজানা। এরই মধ্যে নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, নিজ জমিতে ফেরার নিশ্চয়তাসহ ৮ দফা দাবিতে রোহিঙ্গারা সোচ্চার হচ্ছে। গতকাল সোমবারও তারা বিক্ষোভের চেষ্টা করেছে।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর সময় নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে তারা রাখাইনের কোথায় ফিরবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের মিয়ানমারবিষয়ক দূত ইয়াংহি লি কাতারভিত্তিক টেলিভিশন আল-জাজিরাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘তারা কোথায় ফিরবে? তারা জীবিকা হারিয়েছে, ফসল খুইয়েছে, জমিও তাদের দখলে নেই। তারা বাড়ি হারিয়েছে, কাজেই তাদের বাড়িঘর তৈরি করার কাজটি ব্যাপক। তাই তারা যেন আবারও শিবিরে বসবাসের শিকার না হয়।’

সাক্ষাৎকারটি গত রোববার আল-জাজিরা প্রচার করেছে। সম্প্রতি কক্সবাজার সফরের সময় দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে ইয়াংহি লি আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। তাঁর মতে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রকৃত অবস্থা জানাতে হবে। এরপর তারা ফিরতে রাজি হলেই কেবল সেখানে পাঠানো যেতে পারে। রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়াটা হতে হবে স্বেচ্ছায়।

অবশ্য প্রত্যাবাসন শুরুর আগে রোহিঙ্গাদের পরিবারভিত্তিক তালিকা তৈরি করে মিয়ানমারের কাছে পাঠিয়ে তা চূড়ান্ত করা এবং সীমান্তে অন্তর্বর্তীকালীন শিবিরের মতো অবকাঠামো তৈরির কাজও বাকি আছে।

শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম রোববার প্রথম আলোকে বলেন, প্রত্যাবাসন শুরু করতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। মূল কাজটি শুরুর আগে তালিকা চূড়ান্ত এবং ট্রানজিট ক্যাম্প তৈরির কাজ শেষ করতে হবে। পরিবারভিত্তিক তালিকা করার কাজ শুরু হয়েছে। পরিবারভিত্তিক তালিকার কাজ শেষ হলে সেটিকে গ্রাম এবং এলাকার ভিত্তিতে সমন্বয় করতে হবে। সব মিলিয়ে তালিকা তৈরির কাজ শেষ করতে কমপক্ষে দুই থেকে তিন সপ্তাহ লাগবে।

গতকাল উখিয়ার থাইংখালী শিবিরের ডি ব্লকে গিয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেখানে আশ্রয় নেওয়া সাড়ে তিন হাজার পরিবারের ১৭ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। পাশের সি ব্লকে তালিকা তৈরির কাজ শেষ হয়েছে আরও ১০ দিন আগে।

প্রক্রিয়াগত বিষয় চূড়ান্ত, ভৌত ও কাঠামোগত ব্যবস্থা তৈরি এবং মাঠপর্যায়ে প্রত্যাবাসন শুরু—এই তিন ভাগে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে ভাগ করেছেন আবুল কালাম। তিনি জানান, প্রথম ধাপ শেষ করে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ চলছে। তালিকা তৈরির পাশাপাশি পাঁচটি ট্রানজিট ক্যাম্পের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে।

তবে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়ায় মাঠপর্যায়ে জড়িত কর্মকর্তারা বলছেন, সর্বশেষ চুক্তিতে পাঁচটি ট্রানজিট ক্যাম্পের কথা বলা হলেও মিয়ানমার এ পর্যন্ত দুটি স্থানের ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছে। একটি টেকনাফের নয়াপাড়া। অন্যটি নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম।

সরেজমিন দেখা গেছে, টেকনাফের নয়াপাড়ায় একটি পুরোনো আনসার ক্যাম্প আছে। সেটাকে ট্রানজিট ক্যাম্পে রূপান্তর করতে অনেক কাজ করতে হবে। তা ছাড়া ঘুমধুমে কোনো অবকাঠামো নেই। ফলে এই দুটি ক্যাম্প তৈরি করতে কিছুটা সময় লাগবে।

জাতিসংঘের মানবিক সহায়তার কাজে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর জোট ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৬ লাখ ৮৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এ ছাড়া ২০১৬ সালের অক্টোবরের পর থেকে পরবর্তী কয়েক মাসে আরও ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে।

জানতে চাইলে মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) অনুপ কুমার চাকমা গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পদক্ষেপগুলো যথেষ্ট ইতিবাচক। প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। কাজটি শুরু হলে কোথায় সমস্যা তা বোঝা যাবে। তাই প্রত্যাবাসন শুরু করা জরুরি। কিন্তু প্রত্যাবাসন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল যেভাবে নেতিবাচক প্রক্রিয়া দেখাচ্ছে সেটা ঠিক হচ্ছে না।

বিক্ষোভের চেষ্টা

নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা এবং নিজ জমিতে ফেরার দাবিতে রোহিঙ্গারা ৯ ডিসেম্বর থেকে রোববার পর্যন্ত অন্তত পাঁচবার বিক্ষোভ করেছে। গতকালও আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গারা বিক্ষোভের চেষ্টা করে। সেখানকার বাসিন্দারা জানান, সকালে উখিয়ার জামতলী রোহিঙ্গা শিবিরে বিক্ষোভ করার জন্য হাজারখানেক রোহিঙ্গা জড়ো হয়। নিরাপত্তা বাহিনী নিষেধ করায় তারা আর বিক্ষোভ করেনি। সেখান থেকে বিক্ষোভ সমাবেশের সমন্বয়কারী মো. মহিবুল্লাহকে আটক করা হয়। গতকাল রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মহিবুল্লাহ বাড়ি ফেরেননি বলে তাঁর পারিবারিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এ বিষয়ে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল খায়ের গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, মহিবুল্লাহ নামে কাউকে তারা আটক করেনি। এ নামের কাউকে তাদের কাছে কেউ হস্তান্তরও করেনি।

গতকাল উখিয়ার থাইংখালী ক্যাম্পের সি ব্লকে গেলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে সেখানকার অনেকে প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গে এই প্রতিবেদকের কাছে জানতে চায়। কবে পাঠানো হবে, তাদের পাঠালে সেখানে আবার কোন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয় ইত্যাদি ছিল তাদের প্রশ্ন। পাহাড়ের ওপর রোহিঙ্গা শিবিরের মাঝে গড়ে তোলা এক চা-দোকানে কথা হচ্ছিল কয়েকজনের সঙ্গে। হঠাৎ কথার মাঝে ঢুকে পড়েন এক মধ্যবয়সী নারী। নাম রূপবান, বাড়ি রাচিডং। তিন সন্তানের এই জননী স্বজন হত্যার বিচার চেয়ে বললেন, তাঁর স্বামী ও এক সন্তানকে হত্যা করেছে সেখানকার বৌদ্ধ উগ্রপন্থীরা।

রোহিঙ্গারা বলছে, তারা বিপদে পড়ে এ দেশে এসেছে, এ দেশ তাদের প্রতি অশেষ দয়া দেখিয়েছে, আশ্রয় দিয়েছে। এখন সেখানে তাদের নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব ও নিজের বাড়িতে ওঠার সুযোগ না দিলে তারা যাবে না।

মুস্তফা খাতুন নামের ৭০ বছরের এক নারী এগিয়ে এসে বলেন, লাল কার্ড (মিয়ানমারের নাগরিকত্ব) না দিলে তিনি যাবেন না। স্বামী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে হত্যা করেছে মিয়ানমারের সেনারা। তাদের জানাজা ছাড়া কবর দিতে হয়েছে। এখানে যদি না খেয়েও মারা যান, অন্তত জানাজা ও দাফন ঠিকভাবে হবে।