দলে কোণঠাসা শামীম ওসমান

☼ সম্প্রতি আইভীর সঙ্গে সংঘাতে জড়ান শামীম।
☼ সাত খুনের ঘটনার পর থেকে শামীম চাপে পড়তে থাকেন।
☼ আইভী দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র হলে আরও কোণঠাসা হন শামীম।
☼ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে কেন্দ্রে ও নারায়ণগঞ্জে শামীম অবস্থান হারিয়েছেন।

নিজের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে কেন্দ্রে ও নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগে আগের অবস্থান হারিয়েছেন শামীম ওসমান। এর ফলে শহরে তাঁর ব্যবসায়িক এবং আধিপত্যের জায়গাগুলো দুর্বল হচ্ছিল। কিছু ঘনিষ্ঠজন সরেও যাচ্ছিলেন তাঁর কাছ থেকে।

এ পরিস্থিতিতে নিজের অবস্থান জানান দিতে হকার উচ্ছেদের বিষয় পুঁজি করে পরিকল্পিতভাবে সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে সংঘাতে জড়ান শামীম ওসমান। স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত এবং স্থানীয় রাজনীতির গতিপ্রকৃতির প্রতি নজর রাখেন এমন ব্যক্তিরা সাম্প্রতিক আলোচিত ঘটনাটিকে এভাবেই দেখছেন।

শামীম ওসমানের বিপরীতে অবস্থান শক্ত হচ্ছিল ওসমান পরিবারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর। আলোচিত সাত খুনের ঘটনার পর থেকে চাপে পড়তে থাকেন শামীম ওসমান। এর মধ্যে আইভী দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় আরেকটু কোণঠাসা হন শামীম। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই হিসাব-নিকাশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলেও স্থানীয়ভাবে আলোচনা ছিল।

আলোচনায় আসতে শামীম ওসমানের সুযোগ খোঁজার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৫ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ হকার্স সংগ্রাম পরিষদের সমাবেশে তাঁর যেচে গিয়ে সংহতি প্রকাশ থেকে। সেখানেই তিনি ঘোষণা দেন, পরদিন (১৬ জানুয়ারি) থেকে হকাররা ফুটপাতে বসবে। ওই দিনই মেয়র আইভীর ওপর সশস্ত্র হামলা হয়। এতে আইভী, ১২ সাংবাদিকসহ অর্ধশত ব্যক্তি আহত হন।

নারায়ণগঞ্জ হকার্স সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আসাদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ করায় রাইফেল ক্লাবে গিয়ে আমরা এমপির সঙ্গে (শামীম ওসমান) দেখা করেছিলাম। কিন্তু আমাদের সমাবেশে তাঁকে দাওয়াত করা হয়নি এটা সত্য।’

স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হকার উচ্ছেদের বিষয়টি নিয়ে শামীম ওসমান যে একটা

গোলমাল বাধাতে যাচ্ছেন, তা জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা আগেই টের পান। কোনো কোনো নেতা এ কারণে তাঁদের অনুসারী কর্মী-সমর্থকদের ওই দিন চাষাঢ়া এলাকায় যেতে নিষেধও করেছিলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহানগর আওয়ামী লীগের একজন প্রথম সারির নেতা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কর্মীদের বলেছি, মেয়র-এমপির গোলমালে যাবা না। ওই দিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চাষাঢ়ায় না যাওয়ার নির্দেশনা ছিল।’

মেয়র আইভী ও শামীম ওসমানের সাম্প্রতিক বিরোধের কারণ অনুসন্ধান করে কয়েকটি বিষয় জানা গেছে। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের নতুন কমিটিতে শামীম ওসমানের অনুসারীদের পদ কম পাওয়া, তাঁর একসময়ের ঘনিষ্ঠজনদের অনেকের তাঁকে ছেড়ে যাওয়া শামীম ওসমানের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের চাঁদাবাজির বড় উৎসস্থল ফুটপাত হকারমুক্ত করা এবং জেলার পরিবহন খাতে তাঁর অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণ ও সরকারি সম্পত্তি দখলমুক্ত করার উদ্যোগ। বিশেষ করে এই দুই উদ্যোগে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন শামীম ওসমান।

নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, দলের কেন্দ্র থেকে অনুমোদন দেওয়া জেলা আওয়ামী লীগের নতুন কমিটিতে আইভীর পছন্দের ব্যক্তিরা প্রাধান্য পেয়েছেন। কমিটির প্রায় ৭০ ভাগ নেতা আইভীর সমর্থক। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের ইচ্ছায় কমিটি গঠনে আইভীর পছন্দের নেতাদের গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে দলের মহানগর কমিটির বেশির ভাগ নেতা ছিলেন শামীম ওসমানের অনুসারী। কিন্তু সম্প্রতি মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহাসহ শীর্ষস্থানীয় কয়েক নেতা শামীম ওসমানের পক্ষ ত্যাগ করেছেন। একই অবস্থা তৈরি হয় যুবলীগে। শামীম ওসমানের খুব কাছের মানুষ ছিলেন আইভীর আত্মীয় জেলা যুবলীগের সভাপতি আবদুল কাদির, নারায়ণগঞ্জ সদর থানার সাধারণ সম্পাদক আল মামুন ও বন্দর থানার সাধারণ সম্পাদক আবেদ হোসেন। তাঁরাও শামীমের কাছ থেকে সরে গেছেন।

জানতে চাইলে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা বলেন, ‘শামীম ওসমানের সঙ্গে আমার ৪৫ বছরের ঘনিষ্ঠতা। এখন আর সে সম্পর্ক-যোগাযোগ নেই।’

কেন সম্পর্ক ছুটে গেল—এমন প্রশ্নের জবাবে খোকন সাহা বলেন, ‘আমি নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী। এটি শামীমের পছন্দ হয়নি। কারণ, সেখানে তার ভাই সেলিম ওসমান সংসদ সদস্য। ১৯৭২ সাল থেকে রাজনীতি করি। আমাদের কী জনপ্রতিনিধি হওয়ার ইচ্ছা নেই?’

এ ছাড়া আওয়ামী লীগের নেতা ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আনিসুর রহমান, যুব মহিলা লীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদা মালা ও ইয়াসমিন চৌধুরীও শামীম ওসমানের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। তাঁরাও শামীমের কাছ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এ পর্যন্ত সব হজম করলেও যুব মহিলা লীগের জেলা কমিটিতে বাগড়া দিয়েছেন শামীম ওসমান। গত বছরের মে মাসে ইয়াসমিন চৌধুরীকে জেলা কমিটির আহ্বায়ক ও নুরুন নাহারকে মহানগরের আহ্বায়ক করে কমিটি করে দেয় কেন্দ্রীয় যুব মহিলা লীগ। কিন্তু শামীম ওসমানের হস্তক্ষেপে ১৩ দিনের মাথায় কমিটি বাতিল করা হয়। এরপর শামীমের পছন্দে সাদিয়া আফরিনকে জেলা যুব মহিলা লীগের আহ্বায়ক ও সুইটি ইয়াসমিনকে মহানগরীর আহ্বায়ক করে কমিটি পুনর্গঠন করা হয়।

ইয়াসমিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘শামীম ওসমান দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো তাঁর কবজায় নিতে চান বলেই আমাদের কমিটি বাদ দিয়ে তাঁর অনুগতদের দিয়ে নতুন করে কমিটি করিয়েছেন।’

জানা গেছে, ঢাকার মতোই নারায়ণগঞ্জ শহরের ফুটপাত থেকেও প্রতিদিন মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি হয়। নগরীর বঙ্গবন্ধু সড়কসহ বিভিন্ন সড়কে তিন হাজারের বেশি হকার বসে। হকারদের দেওয়া তথ্য হিসাব করে দেখা যায়, নগরীর ফুটপাত থেকে মাসে চাঁদা আদায় হয় প্রায় ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এই চাঁদা স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন, রাজনীতিক ও সন্ত্রাসীদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়। ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলা ব্যক্তিদের অধিকাংশই শামীম ওসমানের অনুসারী বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান। মেয়র আইভী ফুটপাত দখলমুক্ত করতে জোরালো অবস্থান নিলে শামীম হঠাৎ এর বিপক্ষে অবস্থান নেন এবং তাঁর অনুসারীরা আইভীর ওপর সশস্ত্র হামলা চালান।

নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফুটপাতে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। তিনি (শামীম ওসমান) ৫ লাখ নগরবাসীর সুবিধার কথা বিবেচনা না করে কয়েক হাজার হকারের পক্ষে ক্যাডার বাহিনী দিয়ে হামলা চালিয়েছেন।’

নারায়ণগঞ্জের পরিবহন খাতও চাঁদাবাজির আরেকটি বড় উৎস। পরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে নারায়ণগঞ্জ বাস মালিক সমিতি নিয়ন্ত্রণ করেন ইব্রাহিম চেঙ্গিস ও মুক্তার হোসেন। তাঁরা শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠজন। এঁদের বিরুদ্ধে পরিবহনমালিকেরা চাঁদাবাজির অভিযোগে সংবাদ সম্মেলনও করেছেন। মুক্তার নারায়ণগঞ্জ বাস-মিনিবাস মালিক ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান। আর ইব্রাহিম চেঙ্গিস নারায়ণগঞ্জ-মিরপুর রুটের হিমাচল পরিবহনের মালিক ও বন্ধন পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এই রুটে শীতল পরিবহন নামে সাংসদ শামীম ওসমানের জেড এন করপোরেশনের মালিকানাধীন বাসও আছে। এর দেখভাল করেন চেঙ্গিস। সম্প্রতি চেঙ্গিস জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন।

অবশ্য মুক্তার হোসেন পরিবহন থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, এসব মিথ্যা কথা। উনি (মেয়র) একতরফাভাবে বলে যাচ্ছেন। এভাবে বললে তো কিছু করার নেই।

জানা গেছে, এসব প্রভাবশালী ব্যক্তির পরিবহন ব্যবসার স্বার্থে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বিআরটিসির বাস নারায়ণগঞ্জ সড়ক থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ গত বছরের মাঝামাঝি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস সার্ভিসও বন্ধ করে দেয়। যদিও বিআরটিসির কর্মকর্তারা এই পথে বাস চলাচলে লোকসানের অজুহাত তুলেছেন।

যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরামের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি প্রথম আলোকে বলেন, একচেটিয়া আধিপত্যের জন্য শামীম ওসমান ও তাঁর অনুসারী চক্র বিআরটিসির অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সরকারি গণপরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এরা নারায়ণগঞ্জকে জিম্মি করে রেখেছে।

মেয়র হিসেবে আইভীর এক বছর পূর্তিতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ৯ জানুয়ারি ‘জনতার মুখোমুখি’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সে অনুষ্ঠানে আইভী ইব্রাহিম চেঙ্গিসের সিটি করপোরেশনের পুকুর দখল ও মুক্তার হোসেনের মাসদাইর বাজার দখল করার কথা জানান এবং এই সরকারি সম্পত্তি উদ্ধারের ঘোষণা দেন। এই অনুষ্ঠানে মেয়র ফুটপাতমুক্ত করার ঘোষণাও দেন।

মুক্তার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাসদাইর বাজারটি ১৯৬৫ সাল থেকে স্থানীয় সমবায় সমিতি চালায়। আমি যুক্ত হয়েছি বছর দশেক থেকে। এর আগে বিএনপির তৈমুর আলম খন্দকার সমিতির সভাপতি ছিলেন। বাজারের জায়গাটির মালিক জেলা প্রশাসক। সমিতি লিজ নিয়েছে। সম্প্রতি জমির মালিকানা দাবি করেছে সিটি করপোরেশন। এ নিয়ে মামলা চলছে।’

নগরের নিতাইগঞ্জ ট্রাকস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন হাজি রিপন। তিনিও শামীম ওসমানের অনুসারী। এখানে ৫ শতাধিক ট্রাক থাকত। ট্রাকপ্রতি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা চাঁদা আদায় করা হতো। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও এই ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ হচ্ছিল না। পরে মেয়র আইভীর চাপে প্রশাসন ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ করে। এতে অবশ্য স্থানীয় সাংসদ সেলিম ওসমান সহায়তা করেন।

২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভীর কাছে শামীম ওসমান ১ লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। তখন থেকে দুজনের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ব্যক্তিগত পর্যায়ে গড়ায়। ২০১৬ সালে শামীম ওসমান আর দলীয় মনোনয়ন পাননি। আইভী দ্বিতীয় দফায় মেয়র নির্বাচিত দলে তাঁর গুরুত্ব বাড়ে। জনমতে হেরে যাওয়া এবং বারবার বিতর্কে জড়ানোয় কেন্দ্রে গুরুত্ব কমে শামীম ওসমানের।

এ অবস্থায় মেয়রের ওপর হামলার ঘটনাটি অকারণ ও দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাই। তিনি বলেন, যেখানে স্থানীয় সাংসদ সেলিম ওসমান, ডিসি-এসপি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বঙ্গবন্ধু সড়কে হকার থাকবে না, সেখানে শামীম ওসমানের এ ঘটনায় জড়ানো ঠিক হয়নি। তিনি আওয়ামী লীগের কারও সঙ্গে আলোচনা না করে নিজ উদ্যোগে সেখানে গেছেন। ঘটনা ঘটেছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দল।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য গত দুই দিন মুঠোফোনে শামীম ওসমানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তিনি ফোন ধরেননি।