দৃশ্যমান হবে মোগল ইতিহাস

নিমতলী দেউড়ি। আজ জাদুঘর হিসেবে উদ্বোধন হবে পুরান ঢাকার এই ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাটির l ছবি: সাইফুল ​ইসলাম
নিমতলী দেউড়ি। আজ জাদুঘর হিসেবে উদ্বোধন হবে পুরান ঢাকার এই ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাটির l ছবি: সাইফুল ​ইসলাম

ঢাকার ঐতিহাসিক নিমতলী প্রাসাদের নাম এখনো লোকমুখে রয়ে গেছে। বাস্তবে প্রাসাদটি নেই। টিকে আছে কেবল প্রধান প্রবেশদ্বার। সেখানেই এখন গড়ে তোলা হচ্ছে ঐতিহ্য জাদুঘর। আজ মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এর উদ্বোধন করবেন।

নিমতলীতে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রথম ভবনের পেছনেই তিনতলাবিশিষ্ট এই প্রবেশদ্বার। এটি ‘নিমতলীর দেউড়ি’ বলেই পরিচিত। মূল প্রাসাদটি নির্মিত হয়েছিল ১৭৬৫-৬৬ সালে। ঢাকায় সবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শুরু হচ্ছে। মোগল জমানায় ঢাকার শাসনকাজ করতেন নায়েব নাজিমরা। তখন নায়েব নাজিম ছিলেন জসরত খান। যেখানে কেন্দ্রীয় জেলখানা ছিল, সেখানেই নায়েব নাজিমদের প্রাসাদ ছিল। কোম্পানির শাসকেরা নায়েব নাজিমদের সেখান থেকে সরিয়ে দেন। তাঁদের বসবাসের জন্য নিমতলীতে প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়। বর্তমানের হাইকোর্ট এলাকা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিরাট এলাকা নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এই প্রাসাদ। সেসব এখন বিলুপ্ত। বর্ণনা পাওয়া যায় প্রাচীন পর্যটকদের বিবরণীতে।

জরাজীর্ণ প্রধান ফটকটি ২০০৮ সালে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় এশিয়াটিক সোসাইটি। রাজধানী ঢাকার ৪০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে নিমতলী দেউড়ির চারপাশ প্রত্ন খনন করে ভিত্তিভূমি উন্মোচন করা হয়। কাজ শেষ হয় ২০১২ সালে। এরপর থেকেই এটিকে জাদুঘর করে তোলার পরিকল্পনা শুরু। নাম রাখা হয়েছে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘর’।

এই জাদুঘরের প্রধান গবেষণা সমন্বয়কারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক শরীফ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ঢাকার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নায়েব নাজিমদের শাসন। ইতিহাসের একটি পালাবদলের কাল। একদিকে মোগল শাসনের শেষ পর্যায়, অন্যদিকে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠা পর্ব। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রেই পরিবর্তনের সূচনা হচ্ছিল। নিমতলী প্রাসাদের দেউড়িকে কেন্দ্র করে এই জাদুঘরে সেই ইতিহাস দৃশ্যমান পর্যায়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।

ঐতিহ্য জাদুঘরের কিউরেটরের দায়িত্ব পালন করছেন জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি জানালেন এ পর্যন্ত নবাবি আমলের ৩৪টি নিদর্শন সংগ্রহ করা হয়েছে। জাদুঘরের প্রথম তলায় থাকবে ডিজিটাল মনিটর। তাতে নায়েব নাজিমদের আমলে ঢাকার ইতিহাসভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হবে। এ ছাড়া থাকবে নিমতলী প্রাসাদ ও ২৫০ বছরের ঢাকার মোগল স্থাপত্যের তথ্য-উপাত্ত বিবরণ, চিত্রকলা, ইতিহাস ইত্যাদি।

ঢাকার নায়েব নাজিমদের মধ্যে ১৭ জনের নামের তালিকা পাওয়া গেছে। মুর্শিদকুলি খান (১৭১৬-১৭) বাংলা ও উড়িষ্যার সুবাহদার নিযুক্ত হলে ঢাকা সুবাহদারের প্রতিনিধি নায়েব নাজিমের প্রশাসনিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। নায়েবরা ১৮৪৩ পর্যন্ত এই পদে বহাল থাকলেও তাঁরা ছিলেন ক্ষমতাহীন।

প্রথম নায়েব নাজিম খান মুহাম্মদ আলী খান (১৭১৭ খ্রি.)। শেষ নায়েব নাজিম ছিলেন নিঃসন্তান। তাঁর মৃত্যুর পর নায়েব নাজিম পদটি বিলুপ্ত করা হয়। শেষ চার নায়েব নাজিমের কবর রয়েছে হোসেনি দালান ইমামবাড়া গোরস্থানে। নায়েব নাজিমদের পরিচিতি ও তথ্যাদি, নবাবি আমলের বিভিন্ন নিদর্শন দিয়ে সাজানো হবে দ্বিতীয় তলা।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি পাকাপোক্ত হওয়ার পরে নায়েব নাজিমরা নামমাত্র পদাধিকারী হয়ে পড়েন। কোনো ক্ষমতাই ছিল না তাঁদের। কোম্পানির ভাতায় তাঁদের দিন চলত। তারপরও তাঁরা অতীতের আভিজাত্য ধরে রাখতে দরবার বসাতেন। মামুলি কিছু বিচার-আচারের চেষ্টা করতেন। নবাব নুসরত জঙ্গের দরবারের একটি ছবি পাওয়া গেছে। সেই ছবির অনুসরণে দরবারের একটি ডিওরমা তৈরি করা হবে তৃতীয় তলায়।

ক্ষমতা না থাকলেও নবাবেরা ছিলেন শিল্প-সংস্কৃতির গভীর অনুরাগী। বিশেষ করে জসরত খানের পৃষ্ঠপোষকতায় নিমতলী প্রাসাদে নিয়মিতই গানবাজনা-নৃত্যের আয়োজন হতো। চিত্রকলা প্রদর্শনী হতো। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঈদের মিছিলটিও হতো নিমতলী প্রাসাদ থেকেই। ঈদ, জন্মাষ্টমী, মহররমের মিছিলসহ বিভিন্ন আলোকচিত্র, ভাস্কর্য, বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণবৃত্তান্ত এসবও থাকবে তৃতীয় তলায়। এসবের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হবে এই প্রাচীন মহানগরীর নবাবি আমলের আবহ।