৪২ বছর পর এক যোদ্ধার দেশে ফেরা

মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান। ছবি: সুমন ইউসুফ
মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান। ছবি: সুমন ইউসুফ

তাঁর বাসার নম্বরের শেষ দুটি সংখ্যা ৭১, ব্যাংক হিসাব নম্বরেও আছে সংখ্যা দুটি, এখন ঢাকায় যে মুঠোফোন নম্বর ব্যবহার করছেন তার শেষেও ৭১। দৈনন্দিন জীবনে তাঁর এমন অনেক কিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ‘৭১’ সংখ্যা। হাবিবুর রহমান নিজে যেমন জড়িয়ে আছেন ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে।

স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে নেওয়া ৫৯ বছরের হাবিবুর রহমান যখন প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন, তখন নিতান্তই কিশোর। দেশের স্বাধীনতার পর আরও একবার প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার প্রতিবাদে ছেড়েছিলেন মাতৃভূমি। অপেক্ষা আর প্রতিবাদে এরই মধ্যে কেটে গেছে ৪২ বছর। এখনো তিনি প্রতিজ্ঞা থেকে সরে যাননি, তবে আংশিক প্রাপ্তির স্বস্তিতে অবশেষে দেশে ফিরেছেন।

৮ জানুয়ারি ঢাকায় এসে উঠেছেন রাজধানীর বিজয়নগরের হোটেল ৭১-এ। ২১ জানুয়ারি দুপুরে সে হোটেলের ক্যাফেতে তাঁর সঙ্গে কথা হলো। হাবিবুর রহমান পরনের ব্লেজারের লেবেল দেখিয়ে বললেন, ‘এই যে দেখুন, কোটটার নম্বরও ৭১। একাত্তর থেকে তো আমি বেরোতে পারি না। তাই যেভাবে পারি একাত্তর সঙ্গে রাখি।’

অভিমান নয়, প্রতিবাদের ৪২ বছর

তখন তিনি িকশোর। ১৯৭৪ সাল
তখন তিনি িকশোর। ১৯৭৪ সাল

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ঢাকাতেই ছিলেন হাবিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার খবর শুনে বিশ্বাস করতে পারেননি। হাবিবুর রহমান বললেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে এই দেশের কেউ হত্যা করতে পারে, এটা আমি বিশ্বাস করতে পারিনি।’ আর যখন সত্যটা জানলেন, ব্যথিত হাবিবুর রাগে-ক্ষোভে-দুঃখে এক কঠিন প্রতিজ্ঞা করলেন। সেটা ছিল—দেশ ছাড়ার, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত দেশে না ফেরার।

হাবিবুর রহমান বললেন, ‘১৩ বছর বয়সে আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি। কিশোর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বঙ্গবন্ধু আমাকে স্নেহ করতেন। তাঁর সঙ্গে ১২ বার সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছি। এই স্মৃতি আমার কাছে অমলিন। যেমনটা তাঁকে হত্যার কথাও প্রতিমুহূর্ত তাড়িয়ে বেড়ায়। কিন্তু সে সময় আমার মতো কিশোরের প্রতিবাদ করার উপায় ছিল না। রাস্তায় নেমে একা প্রতিবাদ করতে পারিনি বলেই দেশ ছেড়েছি।’

১৯৭৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর হাবিবুর রহমান চলে যান ফ্রান্সের প্যারিসে। এই শহরে তিনি তার আগেও এসেছেন। ১৯৭৩ সালে চিকিৎসা নিয়েছেন প্যারিসের হাসপাতালে। ১৯৭৪ সালে ফরাসি সরকারের বৃত্তি নিয়ে ভাষা ও পর্যটন বিষয়ে স্বল্পমেয়াদি কোর্স করেছেন। কিন্তু সেবার যাওয়াটা অন্য রকম।

এখনো প্যারিসেই থাকছেন তিনি। সেখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়াশোনা শেষে কাজ করেছেন ইউনেসকো ও ইউনিসেফসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। এখন যুক্ত আছেন ‘মেদসাঁ সঁ ফ্রঁতিয়েখ (এমএসএফ)’ নামে একটি আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা সংস্থার সঙ্গে। বিয়ে করেছেন এক মার্কিন নারীকে। হাবিবুর রহমানের দুই ছেলে প্যারিসেই প্রতিষ্ঠিত।

ফ্রান্সে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন পরিবার থেকেও বিচ্ছিন্ন ছিলেন। ২০০৫ সালে তাঁকে নিয়ে প্রথম আলোয় প্রকাশ হয়েছিল ‘খুঁজে পাওয়া সোনার ছেলে’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন। এই প্রতিবেদন দেখেই বাংলাদেশে পরিবারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। কিন্তু তখন দেশে আসতে পারেননি। যে প্রতিবাদে তিনি দেশ ছেড়েছিলেন, তাতেই অটল থেকেছেন।

হাবিবুর রহমান বললেন, ‘নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। কয়েকজনের সাজাও কার্যকর হয়েছে। কিন্তু এখনো অনেক খুনি ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাঁদের সাজা না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তি নেই। আমার প্রতিজ্ঞা আমি পুরোপুরি রাখতে পারলাম না আর কী।’

কিশোর যোদ্ধা হাবিবুর

১৯৭১ সালের মে মাস। মুক্তিযুদ্ধ চলছে। ১৩ বছরের হাবিব তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়েন। যুদ্ধে যাওয়ার পরিকল্পনা আঁটছেন অনেক দিন ধরে। কিন্তু কীভাবে যাবেন, পরিবারকে কী বলবেন—সেসব ঠিক করতে পারছিলেন না। অবশেষে এক বিকেলে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। মামা আলাউদ্দিনসহ তাঁদের দলটি শ্রীপুর থেকে কাপাসিয়া, ভৈরব হয়ে ভারতের আগরতলার হাপানিয়া প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে গেল। সেদিনগুলো তাঁর কাছে এখনো উজ্জ্বল। মাকে না জানিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার ব্যথা তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। তবু দেশের জন্য কিছু করবেন, এই সংকল্প তাঁকে সাহস জোগাত। প্রশিক্ষণ শেষে নিজের এলাকায় যুদ্ধের জন্য পাঠানো হয় হাবিবকে; ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনে গোলাঘাট, কাওরাইদ সেতু, কাপাসিয়া প্রভৃতি এলাকার বিভিন্ন অপারেশনে ছিলেন তিনি।

গ্রুপ কমান্ডারের সই করা হাবিবুরের পরিচয়পত্র
গ্রুপ কমান্ডারের সই করা হাবিবুরের পরিচয়পত্র

এমন একটি অপারেশন ছিল ৫ ডিসেম্বর। ঢাকা থেকে পাকিস্তানিদের ময়মনসিংহ যাওয়ার পথ বন্ধ করতে গোলাঘাট সেতু ওড়ানোর। হাবিবুর রহমান চলে গেলেন সেদিনের সম্মুখসমরে, ‘পাকিস্তানিরা আক্রমণের কথা আগেই জেনে গিয়েছিল। কাছাকাছি যেতেই গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। একটি গুলি আমার ডান কাঁধের নিচের অংশ দিয়ে ঢুকে ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়।’

তারপর কী হয়েছে হাবিব বলতে পারেন না। যখন সংবিৎ ফিরে পেলেন, তখন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরপর দেশ স্বাধীন হলো। অনেক হাসপাতাল ঘুরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ১৯৭৩ সালে প্যারিসে পাঠানো হলো হাবিবসহ আরও কয়েকজনকে। বিভিন্ন সময়ে পাঁচটি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ১৯৭৪ সালে তাঁর চিকিৎসা শেষ হয়।

 স্মৃতি নিয়ে ফেরা

হাবিবুর রহমানকে দেখতে এসেছিলেন গ্রামের মানুষ
হাবিবুর রহমানকে দেখতে এসেছিলেন গ্রামের মানুষ

ঢাকায় এসে ১৪ জানুয়ারি গিয়েছিলেন নিজের এলাকা শ্রীপুরের কাওরাইদে। তাঁর বাবা-মা আগেই মারা গেছেন। ছোট এক ভাইকেও হারিয়েছেন কিছুদিন আগে। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। মিলিত হয়েছিলেন একাত্তরের সহযোদ্ধা ও এলাকাবাসীর সঙ্গে। হোটেলেও অনেক নিকটাত্মীয় আসছেন দেখা করতে। কখনো নিজেই ছুটে যাচ্ছেন অনেকের বাসায়। জানুয়ারির শেষের দিকে আবার প্যারিসে ফিরতে চলা এ মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘এই ঢাকা আমার অচেনা। অনেক পরিবর্তন হয়েছে। চেনা মানুষগুলোও তো অনেকটা অচেনা হয়ে গেছে। এত দিন পর এসে দেশ থেকে কিছু সুখস্মৃতি নিয়ে গেলাম। আগামী দিনগুলো এই স্মৃতি নিয়েই চলতে পারব।’