নিজের দেশে ভবিষ্যৎ নেই

>
  • বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম তরুণদের নিয়ে জরিপ করেছে।
  • বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৮২ শতাংশ তরুণ দেশ ছাড়তে চান।
  • তরুণদের সবচেয়ে পছন্দের দেশ যুক্তরাষ্ট্র।
  • তরুণদের চাওয়া নিয়ে নীতি নির্ধারকদের গভীর ভাবনা কম।
  • তরুণেরা চাকরি নয়, উদ্যোক্তা হতে চায়।

মনে করেন না যে নিজের দেশে তাঁদের ভবিষ্যৎ আছে। আর এ ক্ষেত্রে এখনো তরুণদের সবচেয়ে পছন্দের দেশ যুক্তরাষ্ট্র।

তরুণদের নিয়ে করা এক জরিপে নিজের দেশে না থাকতে চাওয়ার এই চিত্র পাওয়া গেছে। কেন তাঁরা দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান? বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার তরুণেরা মনে করেন, নিজেদের দেশে সবার জন্য সমান সুযোগ নেই। জরিপে প্রশ্ন ছিল, সমাজে কোন কোন ঘাটতি তাঁদের জীবনযাপন ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় প্রভাব ফেলছে। তাঁরা এ জন্য পাঁচটি বাধার কথা বলেছেন। অর্ধেক তরুণই বলেছেন, তাঁদের সমাজে অসমতাই বড় প্রতিবন্ধকতা। এ ছাড়া তরুণেরা মনে করেন, দেশে তাঁরা নির্ভয়ে জীবনযাপন করতে পারছেন না, নিজের জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারেন না, নিজের পছন্দের জায়গায় কাজ করা যায় না এবং ন্যায্য বিষয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা সম্ভব হয় না।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বা ডব্লিউইএফ) তরুণদের নিয়ে এই জরিপ করেছে। এ জন্য বিশ্বের ১৮৬টি দেশের ৩১ হাজারের বেশি তরুণের মতামত নেওয়া হয়। তবে এবারের এই গবেষণা জরিপ মূলত করা হয়েছে মহাদেশ ধরে। এর মধ্যে বাংলাদেশসহ ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রায় ১ হাজার ৩০০ তরুণের মতামত নেওয়া হয়েছে। ‘গ্লোবাল শেপার্স সার্ভে ২০১৭’ শীর্ষক এ জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে, যাঁরা মিলেনিয়ালস নামে পরিচিত। গত বছরের ৩১ মার্চ থেকে ৩০ জুনের মধ্যে জরিপের জন্য মতামত সংগ্রহ করা হয়।

তরুণদের নিয়ে করা প্রথম আলোর জরিপেও প্রায় একই চিত্র উঠে এসেছিল। বাংলাদেশের ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী ১ হাজার ২০০ তরুণের মতামত নিয়ে গত বছরের জুলাইয়ে করা হয়েছিল তারুণ্য জরিপ-২০১৭। এই জরিপে ৮২ শতাংশ তরুণ বলেছিলেন, ভবিষ্যৎ কর্মজীবন নিয়ে তাঁরা অনিশ্চয়তায় থাকেন। আর সবার জন্য সমান সুযোগের অভাবকেই কর্মজীবনের অনিশ্চয়তার বড় কারণ বলে উল্লেখ করেছিলেন তরুণেরা। এ ছাড়া দুর্নীতি ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথা জানান ৫০ শতাংশের বেশি তরুণ।

সুযোগের অসমতা বড় সমস্যা

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের তরুণদের জন্য প্রশ্ন ছিল ছয়টি। প্রথমে জানতে চাওয়া হয়েছিল, আজকের দিনে কোন সমস্যাটি আপনার দেশকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে? জবাবে ৪৭ শতাংশ তরুণ জানিয়েছেন, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সুযোগের অসমতা তাঁদের দেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা। ৩৫ শতাংশ তরুণের মতে দারিদ্র্য ও ৩৪ শতাংশ শিক্ষার অভাবকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য বড় সমস্যা মনে করেন।

এরপর তরুণদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তাঁদের ক্ষমতায়নে কোন তিনটি বিষয় সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এতে ৫৮ শতাংশ তরুণ জানিয়েছেন, তাঁদের ক্ষমতায়নে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নতুন উদ্যোক্তা বা স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগকে তরুণদের ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন ৫৪ শতাংশ। আর ৪২ শতাংশের মতে, মুক্ত গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা তরুণদের ক্ষমতায়নে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

সাম্প্রতিক প্রযুক্তির ব্যবহার কোন খাতের উন্নয়নে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, এমন প্রশ্নও জরিপে করা হয় তরুণদের। এতে ২০ শতাংশ তরুণ জানিয়েছেন, প্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষার উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া কৃষি, সরকার পরিচালনা, অবকাঠামো উন্নয়ন ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নে প্রযুক্তির ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে তরুণেরা মনে করেন।

ভালো কাজ খুঁজে পেতে এবং কর্মজীবনের উন্নয়নে কোন দেশে যেতে আগ্রহী, এমন প্রশ্নে দক্ষিণ এশীয় ২৪ শতাংশ তরুণ যুক্তরাষ্ট্রকে প্রথম পছন্দের দেশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তরুণদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষ পাঁচে থাকা অন্য দেশগুলো হলো যথাক্রমে কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়া। ৫৬ শতাংশ তরুণ জানিয়েছেন, অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানে তাঁর দেশের সরকারের জোরালো ভূমিকা রাখা উচিত।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, তরুণদের সামনে রেখেই এখন দেশের সব উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে। এসব উন্নয়নকাজে ভবিষ্যতে প্রচুর মেধাবী তরুণের দরকার পড়বে। তাই তরুণদের হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মেধাবী তরুণদের একটি বড় অংশ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এখানে দেশাত্মবোধ তৈরির একটি বিষয় আছে।

সুযোগের সমতার বিষয়ে শামসুল আলম বলেন, সুযোগের সমতা নেই, এটাও সঠিক নয়। তবে সরকারি নিয়োগে কোটার বদলে মেধাবীদের আরও বেশি সংখ্যায় নিয়োগ কীভাবে দেওয়া যায়, সেটি পুনর্বিবেচনার সুযোগ আছে।

রাষ্ট্র ভাবে না তরুণদের কথা

জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বের তরুণদের ৫৬ শতাংশ মনে করেন, রাষ্ট্র পরিচালক বা নীতিনির্ধারকেরা সিদ্ধান্ত নিতে তরুণদের বিষয়ে খুব একটা ভাবেন না। অথবা তরুণদের কণ্ঠস্বর রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। জরিপের এমন ফলাফল সম্পর্কে ডব্লিউইএফ বলছে, সাড়ে ৭৫০ কোটি জনসংখ্যার এই বিশ্বে অর্ধেকের বয়স ৩০ বছরের নিচে। বিশাল এই জনগোষ্ঠীর চাওয়া নিয়ে নীতিনির্ধারকেরা গভীরভাবে ভাবেন না। এ কারণে তাঁদের চাওয়া-পাওয়া বিশ্ব পরিচালনায় উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে।

জরিপে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় তিনটি সমস্যা সম্পর্কে তরুণদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। উত্তরে তাঁরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, বড় আকারের সংঘাত বা যুদ্ধ এবং বৈষম্য এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমস্যা। ৯০ শতাংশ তরুণ এ–ও মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশের ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে, এর জন্য মানুষের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড মূলত দায়ী।

বদলাচ্ছে চিন্তার ধরন

আজ থেকে দু-তিন দশক আগেও সারা বিশ্বের তরুণেরা শিক্ষাজীবন শেষে মূলত চাকরিনির্ভর পেশার কথা ভাবতেন। এখন তরুণদের এই মনোভাবে পরিবর্তন হয়েছে। তরুণেরা এখন নিজ উদ্যোগে কিছু করতে চান, অপরকে কাজ করার সুযোগ দিতে চান। নিজেদের এই স্বপ্নপূরণে তরুণেরা এখন উদ্যোক্তাসহায়ক একটা পরিবেশ চান। একই সঙ্গে অবাধ ইন্টারনেট ব্যবহার এবং যেকোনো মাধ্যমে মতপ্রকাশের জন্য স্বাধীন মাধ্যম চান।

চাকরি করার পরিবর্তে উদ্যোক্তা হতে তরুণদের আগ্রহের কারণ সম্পর্কে গবেষণায় বলা হয়েছে, মিলেনিয়ালরা মনে করেন, নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবননির্ভর বিভিন্ন উদ্যোগের কোনো বিকল্প এখন নেই। এ জন্য প্রযুক্তিভিত্তিক স্টার্টআপ বা নতুন উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান তৈরিতে তরুণেরা বেশি আগ্রহী।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাবে, বর্তমানে বিশ্বে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী বেকার তরুণের সংখ্যা ৭ কোটি ১০ লাখ। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে বর্তমানে বাংলাদেশে কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯৪ হাজার। তাঁরা মজুরির বিনিময়ে সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করার সুযোগও পান না।'