একটি প্রতারণার গল্প

ইংল্যান্ডের একটি চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় কিছু ছবি পাঠিয়েছিলেন চিত্রশিল্পী নাদিরা আক্তার। ওই প্রতিযোগিতায় তিনি তিন লাখ পাউন্ড পুরস্কার জিতেছেন এবং সেই অর্থ ছাড় করাতে টাকা খরচ করতে হবে—এ কথা বলে ওই নারীর কাছ থেকে ১ কোটি ১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি প্রতারক চক্র।

এই প্রতারণার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ২ ফেব্রুয়ারি সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে দুজন বাংলাদেশি ও অন্যরা নাইজেরিয়ার নাগরিক।

সিআইডি সূত্র জানায়, ইংল্যান্ডের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় নাদিরা আক্তারের ছবি পাঠানোর তথ্য কোনোভাবে সংগ্রহ করে প্রতারক চক্র। তারপর চক্রের একজন নিজেকে ইংল্যান্ডের ওই চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে নাদিরাকে বলেন, প্রতিযোগিতায় নাদিরার ছবি পুরস্কার জিতেছে এবং সেই পুরস্কার পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপর শামীমা রহমান পরিচয় দিয়ে এক নারী নাদিরাকে ফোনে বলেন, তাঁর নামে একটি পার্সেল চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে। পার্সেলে তিন লাখ পাউন্ড আছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ পার্সেলটি স্ক্যান করে পাউন্ড দেখে আটকে দিয়েছে। পার্সেলটি ছাড়িয়ে নিতে অনেক টাকা লাগবে।

সিআইডি জানায়, পার্সেল আটকে থাকার খবর দেওয়ার পর থমাস কিং নামের আরেকজন নাদিরাকে ফোন করে বলেন, তাঁর নামে যে পার্সেল এসেছে, তা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ আটকে দিয়েছে এবং এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। পার্সেলটিতে তিন লাখ পাউন্ড ছাড়াও মূল্যবান উপহার আছে। পার্সেলটি ছাড়াতে প্রয়োজনে টাকা খরচ করার পরামর্শ দেন ওই ব্যক্তি। দফায় দফায় থমাস কিং ও শামীমা রহমান নাদিরাকে ফোন করে পার্সেলটি ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য টাকা দিতে বলেন। একপর্যায়ে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় তিন কোটি টাকা ও বিভিন্ন দামি উপহারের জন্য টাকা খরচ করতে নাদিরা সম্মত হন। পরে পার্সেল পেতে তাঁদের দেওয়া একটি ব্যাংক হিসাব নম্বরে ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা পাঠান নাদিরা। এই টাকা পাওয়ার পর চক্রের সদস্যরা আরও টাকা লাগবে বলে জানান। নাদিরা চক্রের কথামতো আরেকটি ব্যাংক হিসাবে আরও দুই লাখ টাকা পাঠান। তারপরেও পার্সেলটি হাতে না পেয়ে চক্রের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন নাদিরা। যোগাযোগ করলে নাদিরাকে জানানো হয়, তিন কোটি টাকার পার্সেল এত অল্প টাকায় ছাড়িয়ে নেওয়া যাবে না, আরও টাকা লাগবে। এরপর নাদিরাকে মামলার ভয় দেখিয়ে এবং কোটি টাকার পুরস্কারের প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব নম্বরে ১ কোটি ১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারক চক্র। তারপরেও পার্সেল না পেয়ে থমাস কিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন নাদিরা। এ সময় থমাস কিং বলেন, অনেক ঝামেলা হয়ে গেছে, পার্সেলটি আর দেওয়া যাবে না এবং তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে নিষেধ করে দেন। যোগাযোগ করলে পরিণাম খারাপ হবে বলেও হুমকি দেন। এরপর নাদিরা বুঝতে পারেন, তিনি বড় ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। পরে তিনি গত ২০ অক্টোবর বনানী থানায় মামলা করেন।

সিআইডি জানিয়েছে, মামলাটি তদন্ত করে বসুন্ধরা ও খিলক্ষেত লেক সিটি এলাকা থেকে এই প্রতারক চক্রের সাত সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে সিআইডি বলছে, প্রতারক চক্রটি প্রথমে অবস্থাসম্পন্ন কাউকে লক্ষ্যবস্তু করে। এরপর তাঁর বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর চক্রের নাইজেরিয়ার সদস্যরা নিজেদের ইউরোপিয়ান বা আমেরিকান পরিচয় দিয়ে ভুয়া ছবি দিয়ে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে। তারপর প্রতারণার ফাঁদে ফেলে। এ কাজে বাংলাদেশি সহযোগীদের কাজ ব্যাংক হিসাব নম্বর সংগ্রহ করা, যার মাধ্যমে ভুক্তভোগী টাকা দেবেন। এই সহযোগিতার বিনিময়ে ব্যাংকের মূল হিসাব নম্বরধারীকে লেনদেন করা টাকার ৫ শতাংশ দেওয়া হয়।

নাদিরা আক্তারের সঙ্গে প্রতারণার ঘটনায় গ্রেপ্তার দুই বাংলাদেশি কাউসার আহমেদ ও রাইসুল ইসলাম। নাইজেরিয়ার নাগরিকেরা হলেন ওগোখোয়া ওনোচি, মরিস, ওবিনা, হ্যানরি ও এন্থনি কেজিতো অ্যারেঞ্জি।

সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া সেল) শারমিন জাহান বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া নাইজেরিয়ার নাগরিকেরা সবাই ফুটবলার হিসেবে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাঁরা দুটি ক্লাবের হয়ে ফুটবলও খেলেছেন। এক-দুই বছর থেকে তাঁরা ফুটবল খেলেন না।