বয়স ও সামাজিক মর্যাদা বিবেচনায় খালেদার ৫ বছর কারাদণ্ড

বিশেষ আদালতে যাচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। চানখাঁরপুল, ঢাকা। ছবি: আশরাফুল আলম
বিশেষ আদালতে যাচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। চানখাঁরপুল, ঢাকা। ছবি: আশরাফুল আলম

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সরকারি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। তবে বয়স ও সামাজিক মর্যাদার কথা বিবেচনা করে খালেদা জিয়ার পাঁচ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। যদিও একই অভিযোগে তাঁর বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ পাঁচজনের ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। 

এ মামলায় কারাদণ্ডের পাশাপাশি প্রত্যেককে ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার ১৫ মিনিট ধরে রায় ঘোষণা করেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এর বিচারক মো. আখতারুজ্জামান।

রায় ঘোষণা উপলক্ষে পুরান ঢাকার বকশীবাজারে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালত চত্বর এলাকায় নজিরবিহীন নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে তোলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। বিচারক মো. আখতারুজ্জামান আদালত এলাকায় আসেন ১০টা ১৯ মিনিটে। সকাল আটটার পর আদালতে আসেন আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। আর খালেদা জিয়া আদালতে আসেন বেলা ১টা ৫০ মিনিটে। আদালত রায় পড়া শুরু করেন ২টা ১৪ মিনিটে। আড়াইটার দিকে রায় ঘোষণার পর খালেদা জিয়াকে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে নিয়ে যাওয়া হয়।

বিদেশ থেকে পাঠানো এতিমদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে বিদেশ থেকে পাঠানো ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করার অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই দুদক এই মামলা করেন। তদন্ত শেষে ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট খালেদা জিয়া, তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন দুদকের উপপরিচালক হারুন অর রশীদ। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ আদালত খালেদা জিয়াসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯, ১০৯ ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় অভিযোগ গঠন করেন।

রায়ে আদালত বলেন, সন্দেহাতীতভাবে দুদক দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারার অভিযোগ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। রায় পড়ার শুরুতে বিচারক আখতারুজ্জামান জানান, এ মামলার রায় ৬৩২ পৃষ্ঠার। পরে তিনি মামলার গুরুত্বপূর্ণ অংশ পড়ে শোনান। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তারেক রহমান, সাবেক সাংসদ কাজী সালিমুল হক কামাল, সাবেক মুখ্যসচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ ও জিয়াউর রহমানের বোনের ছেলে মমিনুর রহমানের ১০ বছর কারাদণ্ড ঘোষণা দেন। এরপর বিচারক বলেন, আসামি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁর সামাজিক মর্যাদার কথা বিবেচনা করে তাঁকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হলো।

দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি তার সরকারি কর্মচারীজনিত ক্ষমতার বা একজন ব্যাংকার, বণিক, আড়তদার, দালাল, অ্যাটর্নি হিসেবে তার ব্যবসায় যেকোনো প্রকারের কোনো সম্পত্তি বা কোনো সম্পত্তির ওপর আধিপত্যের ভারপ্রাপ্ত হয়ে সম্পত্তি সম্পর্কে অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ করেন, সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং তদুপরি অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

রায় ঘোষণার পরপর এজলাস ত্যাগ করেন বিচারক। এজলাসে উপস্থিত আইনজীবী বিএনপি নেতা মাহবুব উদ্দিন খোকন উচ্চ স্বরে বলেন, ‘এটি মিথ্যা মামলা, এটি মিথ্যা মামলা। রায় ঘোষণার পর দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল প্রথম আলোকে বলেন, ‘রায়ে আমরা খুশি। মামলার আলোচ্য বিষয় ছিল ১১টি। আমরা সব অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি।’

অন্যদিকে খালেদা জিয়ার আইনজীবী আবদুর রেজাক খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতের রায়ে আমরা স্তম্ভিত। একজন বৃদ্ধ নারীকে এভাবে কারাদণ্ড দেওয়া নজিরবিহীন। এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।’

রায়ের পর আদালতে উপস্থিত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার রায়। এমন রায় হওয়ায় বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা চলে যাবে। আর দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘দেশে কোনো বিচার নেই।’

নেতাদের কান্না
রায় ঘোষণার পরপরই খালেদা জিয়া তাঁর আইনজীবী আবদুর রেজাক খানসহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেন। এর কিছু সময় পর খালেদা জিয়াকে পুলিশের একটি সাদা গাড়িতে তোলা হয়। এরপর গাড়ির সঙ্গে হাঁটার সময় বিএনপি নেতা মীর নাসির উদ্দিন, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদসহ কয়েকজন কান্নাকাটি করেন। এরপর বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য তাঁকে আদালত থেকে নাজিমউদ্দিন রোডের কারাগারে নিয়ে যান।

যে অভিযোগে সাজা
মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলে ইউনাইটেড সৌদি কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ১২ দশমিক ৫৫ লাখ মার্কিন ডলার আসে, যা বাংলাদেশি টাকায় তৎকালীন ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৮১ হাজার ২১৬ টাকা। তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ১৯৯১ সালের ৯ জুন থেকে ১৯৯৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই অর্থ দেশের প্রতিষ্ঠিত কোনো এতিমখানায় না দিয়ে অস্তিত্ববিহীন জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট গঠন করেন। অথচ কোনো নীতিমালা তিনি তৈরি করেননি, করেননি কোনো জবাবদিহির ব্যবস্থাও। অথচ খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল থেকে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা অস্তিত্ববিহীন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে পাঠান। পরে ওই টাকা আত্মসাৎ করেন, যার জন্য তিনি দায়ী। তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্রে বলেন, খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় থেকে নিজের পদমর্যাদা বলে সরকারি এতিম তহবিলের আর্থিক দায়িত্ববান বা জিম্মাদার হয়ে বা তহবিল পরিচালনার ভারপ্রাপ্ত হয়ে অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গ করে দণ্ডবিধির ৪০৯ এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারার অপরাধ করেছেন।

খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তিনি তাঁর মায়ের সহায়তায় ৬ মইনুল হোসেন রোডের ঠিকানা ব্যবহার করে অস্তিত্ববিহীন ট্রাস্ট গঠন করেন। প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলের ২ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা গ্রহণ করে ওই ট্রাস্টের নামে সোনালী ব্যাংকের গুলশান নিউ নর্থ সার্কেল শাখায় এসটিডি হিসাব খুলে জমা রাখেন। দীর্ঘদিনে কিছু জমি কেনা ছাড়া ট্রাস্টের নামে কোনো স্থাপনা করেননি। ডিড অব ট্রাস্টের শর্ত ভঙ্গ করে এতিম ও দুস্থদের জন্য কোনো টাকা তিনি ব্যয় করেননি। অথচ ২০০৬ সালের ১২ এপ্রিল থেকে ২০০৬ সালের ৪ জুলাই পর্যন্ত অসৎ উদ্দেশ্যে ৫টি চেকের মাধ্যমে ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা ট্রাস্টের সঙ্গে সম্পর্কহীন ব্যবসায়ী কাজী সালিমুল হককে দেন। যার মধ্যে ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাৎ করেন, যা দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারার অপরাধ।

সাবেক মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী সম্পর্কে বলা হয়, তিনি প্রধানমন্ত্রীর সচিবের দায়িত্বে ভারপ্রাপ্ত হয়ে এতিম তহবিল গঠন ও পরিচালনার দায়িত্ববান হন। অথচ কোনো নীতিমালা তৈরি না করে কোনো জবাবদিহির ব্যবস্থা গ্রহণ না করে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অনুমোদন নেন এবং প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের দিয়ে গঠিত অস্তিত্ববিহীন ট্রাস্টে টাকা পাঠান। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনকৃত মূল নথি নিজের দায়িত্বে রেখে বা নিচের স্তরের কাউকে না দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নথি উধাও করে খালেদা জিয়া ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সরকারি টাকা আত্মসাতের কাজে সহায়তা করেছেন।

অভিযোগপত্রে জিয়াউর রহমানের ভাগনে মমিনুর রহমান সম্পর্কে বলা হয়, তিনি তারেক রহমানের সঙ্গে যৌথভাবে প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলের টাকা আত্মসাতের সহযোগিতা করেছেন।