মস্তিষ্কের ছবিতে বুদ্ধির পরিমাপ

মনিটরের পর্দায় ছবি দেখে শিশুর মস্তিষ্কে কী পরিবর্তন হচ্ছে তা বিশেষ প্রযুক্তির মাধ্যমে ধারণ করা হচ্ছে।  ছবি: আইসিডিডিআরবি
মনিটরের পর্দায় ছবি দেখে শিশুর মস্তিষ্কে কী পরিবর্তন হচ্ছে তা বিশেষ প্রযুক্তির মাধ্যমে ধারণ করা হচ্ছে। ছবি: আইসিডিডিআরবি
>
  • গবেষণা করছে আইসিডিডিআরবি।
  • যুক্ত আছে যুক্তরাষ্ট্রের চিলড্রেনস হসপিটাল বোস্টন ও ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়া।
  • গবেষণাকে ‘নজিরবিহীন’ বলেছে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার।
  • আন্তর্জাতিক মহলে ইতিমধ্যে এই গবেষণা নিয়ে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।

মস্তিষ্কের প্রতিচ্ছবি বিশ্লেষণ করে বুদ্ধি নির্ণয়ের গবেষণা চলছে বাংলাদেশে। বিশ্লেষণে তিন ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছে। রাজধানীর মিরপুর এলাকায় চলা ওই গবেষণায় জড়িত বিজ্ঞানীরা বলছেন, অপুষ্টির শিকার শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ কম হয়। গবেষণার ফলাফল কাজে লাগিয়ে ঝুঁকিতে থাকা শিশু চিহ্নিত করা যাবে এবং তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে উদ্যোগ নেওয়া সহজ হবে।

ফলাফল প্রকাশিত না হলেও আন্তর্জাতিক মহলে ইতিমধ্যে এই গবেষণা নিয়ে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। গবেষণাকে ‘নজিরবিহীন’ বলেছে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার। গত বছরের জুলাই মাসে প্রকাশিত ‘দারিদ্র্য কীভাবে মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে’ (হাউ পোভার্টি এফেক্টস দ্য ব্রেইন) শিরোনামের প্রবন্ধে বলা হয়, অপুষ্টি, দুর্বল পয়োব্যবস্থা ও অন্যান্য প্রতিকূলতা শিশু বিকাশে কী প্রভাব ফেলে, তা এই গবেষণা থেকে উন্মোচিত হতে পারে।

গবেষণাটি করছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)। এর সঙ্গে যুক্ত আছে যুক্তরাষ্ট্রের চিলড্রেনস হসপিটাল বোস্টন এবং ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়া। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গেটস ফাউন্ডেশন এতে অর্থায়ন করেছে। গবেষণার প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর ও আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. রাশিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, শারীরিক ও প্রতিবেশগত প্রতিকূলতা শিশুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। এই গবেষণার উদ্দেশ্য বস্তির মতো বিরূপ পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুর মস্তিষ্কের পরিস্থিতি নির্ণয় করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করা।

গবেষক দলের সদস্য আইসিডিডিআরবির শিশু বিকাশবিষয়ক জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. ফাহমিদা তোফায়েল গবেষণার শুরুতে ২০১৬ সালের মার্চে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘ইইজি (ইলেকট্রোএনকেফালোগ্রাম), এফএনআইআরএস (ফাংশনাল নেয়ার ইনফ্রারেড স্পেকট্রোসকপি) এবং এমআরআই (ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং) পরীক্ষার মাধ্যমে মস্তিষ্কের তথ্য ও প্রতিচ্ছবি সংগ্রহ করা হয়। কিছু তথ্য ও প্রতিচ্ছবি বিশ্লেষণ করা হয়েছে চিলড্রেনস হসপিটাল বোস্টনের পরীক্ষাগারে।

‘ব্রেইন ইমেজিং অ্যাজ আ মেজার অব ফিউচার কগনিটিভ আউটকামস ইন চিলড্রেন’ শীর্ষক এই গবেষণায় নমুনা হিসেবে খর্বকায় ও স্বাভাবিক শিশু, নিরক্ষর বা স্বল্প শিক্ষিত মায়ের শিশু এবং বারবার সংক্রমণের শিকার শিশু ও সুস্থ শিশুর মস্তিষ্কের প্রতিচ্ছবি সংগ্রহ করা হয়। এদের মধ্যে ছিল তিন বছর বয়সী শিশু ১৩০ জন এবং ছয় মাসের কম বয়সী শিশু ১২০ জন। এদের মধ্যে এক থেকে তিন মাস বয়সী ৪০টি শিশুর এমআরআই করা হয়েছে সরকারের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালে।

গবেষণা বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা শিশু হাসপাতালের শিশু স্নায়ুবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নায়লা জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ইমেজিং বা প্রতিচ্ছবি খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি। এতে কোনো রেডিয়েশন বা রশ্মি নেই বলে শিশুর ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। তাঁর বিশ্বাস, এই গবেষণা থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসবে।

কী পরীক্ষা হয়েছে
ইইজি ব্যবহার করা হচ্ছে বিশ্রাম বা ঘুমন্ত অবস্থায় শিশুর মস্তিষ্কের কার্যকর সংযোগ পরিমাপ করার জন্য। নতুন ধরনের উদ্দীপকের কারণে মস্তিষ্কের কোন অংশ কীভাবে সাড়া দেয়, তা পরিমাপ করা হয় ইআরপির (ইভেন্ট রিলেটেড পোটেনশিয়ালস) মাধ্যমে। আবার কোনো বিন্যাসে (প্যাটার্ন) পরিবর্তন হলে তা দৃষ্টি দিয়ে বিশ্লেষণের সময় শিশুর মস্তিষ্ক কীভাবে সাড়া দেয়, তা ভিইপি (ভিজ্যুয়াল ইভোকড পোটেনশিয়ালস)-এর মাধ্যমে মাপা হয়।

এফএনআইআরএসের মাধ্যমে মস্তিষ্কের কার্যকলাপ মূল্যায়ন করা যায়। স্নায়বিক কার্যকলাপের পরিণতিতে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ এর মাধ্যমে মাপা হয়। এ ছাড়া বাইরের কোনো উদ্দীপনার কারণে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের সংযোগ ও সক্রিয়তা এর মাধ্যমে পরিমাপ করা যায়। 

এমআরআইয়ের মাধ্যমে তিনটি জিনিস পরিমাপ করা হয়। প্রথমত তিন মাত্রার ছবির মাধ্যমে মস্তিষ্কের পরিমাণ জানা যায়। দ্বিতীয়ত বিশ্রামের সময় বা ঘুমন্ত অবস্থায় মস্তিষ্কের কোন অংশ সক্রিয় থাকে, তা নির্ণয় করা। তৃতীয়ত মস্তিষ্কের ধূসর ও সাদা অংশের অনুপাত বের করা। সাদা অংশ বেশি হলে শিশুর অটিস্টিক হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।

প্রাথমিকভাবে দেখা গেছে, খর্বকায় অর্থাৎ অপুষ্টির শিকার শিশুর বৃদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ সুস্থ শিশুর তুলনায় কম। বারবার রোগে ভুগছে এমন শিশুর তুলনায় নীরোগ শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বেশি। অন্যদিকে নিরক্ষর বা শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা মায়ের শিশু বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে পিছিয়ে।

রাশিদুল হক বলেন, তথ্য সংগ্রহ শেষ হয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণ এ বছর শেষ হবে। ২০১৯ সালের মধ্যে ফলাফল প্রকাশ করা সম্ভব হবে।

গবেষকেরা দাবি করছেন, গবেষণার ফলাফল নিয়ে ঝুঁকিতে থাকা শিশু চিহ্নিত করা যাবে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে উদ্যোগ নেওয়া সহজ হবে। ফাহমিদা তোফায়েল বলেন, প্রতিকূলতার তিনটি সূচক নিয়ে (অপুষ্টি, সংক্রমণ ও মায়ের শিক্ষা) এই গবেষণা হলেও অন্যান্য প্রতিকূল অবস্থার (যেমন নির্যাতন) শিশুদের বিকাশও নির্ণয় করা যাবে।