জান্নাতি না ঝুমুর?

মায়ের দাবি, এই শিশু তাঁর সন্তান ঝুমুর। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
মায়ের দাবি, এই শিশু তাঁর সন্তান ঝুমুর। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

ছবি দুটো বারবার দেখছিলেন আসমা। একটি ছবি তাঁর হাঁতে, আরেকটি কম্পিউটারে। ছবি দুটো মেলানোর চেষ্টা করছেন। চোখে-মুখে দ্বিধা, হতাশা, ক্লান্তি। ছবি দুটো মেলার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। ছবি দুটো মেলার অর্থ—তিন বছর আগে হারিয়ে যাওয়া তাঁর মেয়ের অবস্থান সম্পর্কে সূত্র পাওয়া গেছে।

আসমা এবার এই প্রতিবেদকের দিকে ফিরলেন। বললেন, ‘দ্যাখেন তো কপালের এদিকটা, ভ্রু দুইডা মেলে তাই না!’ কণ্ঠে সমর্থন পাওয়ার প্রত্যাশা। ‘কিন্তু ওর (ঝুমুর) মুখটা আরও ভালো’—এবার কণ্ঠে দ্বিধা। ‘ওর আঙুলে পোড়া দাগ আছে। আপনি কী দ্যাখছিলেন?’ এবার প্রতিবেদককে প্রশ্ন করলেন।

মেয়ের ছবি হাতে আসমা। ছবিটি কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয় থেকে তোলা। ছবি: নাজনীন আখতার
মেয়ের ছবি হাতে আসমা। ছবিটি কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয় থেকে তোলা। ছবি: নাজনীন আখতার

দ্বিতীয় ছবির শিশুটিকে এই প্রতিবেদক রাজধানীর আজিমপুরে ছোটমণি নিবাসে ২০১৬ সালের ১৭ মে দেখে ছবি তুলে রেখেছিলেন। সেখানে শিশুটির নাম বলা হয়েছিল জান্নাতি। পোড়া দাগের বিষয়ে খেয়াল করা হয়নি জানাতেই আসমা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিন বছর ধরেই এমন দীর্ঘশ্বাস ফেলে যাচ্ছেন তিনি।

হাতে ধরা ছবিটি তিনি ফেসবুক থেকে জোগাড় করেছেন। এটি তাঁর মেয়ে ঝুমুর বলে নিশ্চিত তিনি। দ্বিতীয় ছবিটি এই প্রতিবেদকের কাছে আছে জানতে পেরে ছুটে এসেছেন। কিছু তথ্যগত অসংগতি থাকলেও দ্বিতীয় ছবিটির মেয়েটির সঙ্গে ঝুমুরের চেহারার মিল পাচ্ছেন। সামনাসামনি একবার দেখলেই তিনি নিশ্চিত হবেন বলে জানালেন।

আর এই সরাসরি দেখা নিয়েই শুরু হয়েছে যত বাধা-বিপত্তি। অর্থ ব্যয় করার সামর্থ্য না থাকায় নিয়ম নামের আইনি বেড়াজাল এখন আসমার কাছে পাহাড়সমান প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দ্বিতীয় ছবির মেয়েটি, যাকে জান্নাতি বলা হচ্ছে, তার সঙ্গে দেখা করতে এ প্রতিবেদকের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে ছোটমণি নিবাসে ছুটে গেছেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, ওই মেয়েকে দত্তক দেওয়া হয়ে গেছে। কার কাছে দত্তক দেওয়া হয়েছে, সেই তথ্য তাঁরা দেবেন না। মেয়েটিকে দেখতে হলে নরসিংদী আদালতে গিয়ে অনুমতি আনতে হবে।

ঝুমুর যেদিন হারিয়ে যায়
পাঁচ বছর বয়সী শিশুকন্যা ঝুমুর বাসার সামনে থেকে হারিয়ে যাওয়ার পর সাধ্যের মধ্যে খুঁজেছেন আসমা। বললেন, ঠিক ওই দিনই ওর জন্মদিন ছিল। পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছিল। স্থানীয় একটি স্কুলে ভর্তি করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন।

মোতাহার হাওলাদার ও আসমার তিন সন্তানের মধ্যে বড় ঝুমুর। ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি মোহাম্মদপুরে সাত মসজিদ হাউজিংয়ের ৫ নম্বর রোডের বাসা থেকে হারিয়ে যায়।

আসমা ছুটা বুয়ার কাজ করেন। তাঁর স্বামী মোতাহারের কোনো স্থায়ী পেশা নেই। এখন তিনি বাবুর্চির কাজ করেন। এর আগে চালক হিসেবেও কিছুদিন কাজ করেছিলেন। আসমা জানান, ঘটনার দিন সকাল ১০টার সময় বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে ঝুমুরের হাতে ১০ টাকা দিয়ে বলেন কিছু কিনে খেতে। দোতলা বাড়ির গেটের সামনে বসে খেলছিল সে। বেলা তিনটার দিকে বাড়ি ফিরে দেখেন ঝুমুর বাসায় নেই। এরপর চারপাশে খোঁজ শুরু হয়। এলাকায় মাইকিং করা হয়। কিন্তু ঝুমুর নেই যে নেই-ই। তিন বছরেও খুঁজে পাওয়া গেল না তাকে।

আসমা বলেন, বাড়ির আশপাশে থাকা কয়েকজনের কাছ থেকে শুনেছেন, ঝুমুর খেলার সময় ওখানে হাতি নিয়ে আসে এক লোক। হাতি দিয়ে আশপাশের লোকজনের কাছ থেকে টাকা তোলা হচ্ছিল। সমবয়সী এক ছেলের ডাকে ঝুমুর খেলা ছেড়ে হাতি দেখতে চলে যায়।

সেদিন খুঁজে না পেয়ে মোহাম্মদপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন আসমা। এরপর থানায় কয়েকবার যোগাযোগ করেছেন, কিন্তু শিশুকন্যার কোনো খোঁজ দিতে পারেনি পুলিশ। জিডির কপি অনুসারে মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শাজাহান আলী এর দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মিরপুর (কাফরুল) থানায় বদলি হয়ে এসেছি। ওই ব্যাপারে পরে কী হয়েছে তা জানি না।’

আসমা জানান, ঝুমুরের বিষয়ে একেকবার একেকজনের কাছে তথ্য পান। ঝুমুরের ছবি মুঠোফোনে থাকলেও তা সংগ্রহে রাখা হয়নি। গত বছরের শেষের দিকে স্থানীয় এক চায়ের দোকানে বসে তাঁর এক আত্মীয় নাজিম খান রাসেল নামের মোহাম্মদপুর নিবাসী এক ব্যক্তির মুঠোফোনে ঝুমুরের ছবি দেখেন। ছবিটি ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের একটি পোস্ট। হারিয়ে যাওয়া একটি মেয়েকে পরিবার খুঁজে পেতে সহায়তা করার আবেদন। ওই আত্মীয় ওই ব্যক্তির কাছে ছবিটির বিষয়ে জানতে চান। ওই ব্যক্তি জানান, ছবিটি তিনি একটি গ্রুপ থেকে তা পেয়েছেন।

নাজিম খান রাসেলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশপিপল’ নামে একটি গ্রুপ থেকে এই পোস্ট পান। ২০১৬ সালের ২ জুনে দেওয়া ওই পোস্টে ছবিটি শেয়ারের আবেদন জানানো হয়। ওই পোস্টটি তিনি গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর শেয়ার করেন ফেসবুকে।

ঝুমুরের ওই ছবিতে নাম হিসেবে জান্নাতি লেখা ছিল। ছবিটি তাঁর মেয়ে বলে নিশ্চিত করলেও নামে গরমিল রয়েছে বলে জানান আসমা।

আজিমপুর ছোটমণি নিবাসে এই শিশুকে জান্নাতি নামে ডাকা হয়। ছবিটি ২০১৬ সালের ১৭ মে ছোটমণি নিবাস থেকে তোলা। ছবি: নাজনীন আখতার
আজিমপুর ছোটমণি নিবাসে এই শিশুকে জান্নাতি নামে ডাকা হয়। ছবিটি ২০১৬ সালের ১৭ মে ছোটমণি নিবাস থেকে তোলা। ছবি: নাজনীন আখতার

জান্নাতিই কি ঝুমুর?
জান্নাতিই কি তাঁর হারিয়ে যাওয়া বুকের ধন ঝুমুর? আসমার মনে খালি ঘুরপাক খায় এ কথা।
মাস দুয়েক আগে রাজধানীর শাজাহানপুর থানার এসআই শিশির ঘোষ (এখন ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালত-সিএমএমে দায়িত্ব পালন করছেন) তাঁর এক সহকর্মীর ফেসবুকে এক হারিয়ে যাওয়া শিশুর (প্রতিবেদকের কাছে থাকা দ্বিতীয় ছবির শিশু) ছবি দেখেন। ওই শিশুকে নরসিংদী থেকে ঢাকার আজিমপুরের শিশুমণি নিবাসে পাঠানো হয়েছে জানতে পেরে তিনি পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বাড়িতে কাজ করা ছুটা বুয়ার (আসমা) হারিয়ে যাওয়া মেয়ের ছবির সঙ্গে মিল থাকায় তিনি তাঁর অনুরোধে বিষয়টিতে আগ্রহী হন।

এসআই শিশির ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, নানান মাধ্যম হয়ে ছোটমণি নিবাসে তিনি যোগাযোগ করেন। জানতে পারেন, ছোটমণি নিবাসে স্থান পাওয়া শিশুটিকে জান্নাতি নামে ডাকা হচ্ছে। তিনি আসমার সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি জানান। তবে ছোটমণি নিবাসে গিয়ে জানতে পারেন, দ্বিতীয় ছবির শিশুটিকে দত্তক দেওয়া হয়েছে এবং নরসিংদী আদালতের মাধ্যম ছাড়া কাউকে দেখানোর অনুমতি দেওয়া যাবে না।

শিশির ঘোষ আরও বলেন, ‘আমি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছি নরসিংদী গিয়ে আদালতে দৌড়াদৌড়ি করে টাকা ব্যয় করার সামর্থ্য এই পরিবারের নেই। পরিবারটি শিক্ষিতও নয়। একবার যেন মেয়েটিকে দেখতে দেওয়া হয়। তারা নিশ্চিত হলে নাহয় আদালতে যাবে। কিন্তু তারা আমার অনুরোধ রাখেনি।’

এ ব্যাপারে আজিমপুর ছোটমণি নিবাসের উপতত্ত্বাবধায়ক জুবিলি বেগমের কাছে জানতে চাইলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘নরসিংদী থানার পুলিশ জান্নাতিকে (দ্বিতীয় ছবির শিশু) এখানে পাঠিয়েছে। আদালতের মাধ্যমে তাকে দত্তক দেওয়া হয়েছে। এভাবে যখন-তখন কাউকে দেখানোর নিয়ম নেই। তা ছাড়া নথিপত্রে এই শিশুটির যে তথ্য দেওয়া আছে, তার সঙ্গে ওই নারীর সন্তান সম্পর্কে দেওয়া তথ্য মেলে না।’

হারিয়ে যাওয়া শিশুকে এভাবে দত্তক দেওয়া কি নিয়মের মধ্য পড়ে? এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। প্রকৃত বাবা-মা দাবি করলে দিয়ে দিতে বাধ্য থাকবেন দত্তক নেওয়া বাবা-মা। তবে সেটা আদালত থেকে হতে হবে।’

দরিদ্র এই পরিবারের জন্য আইন-আদালতের নিয়মকানুন সেরে শিশুটিকে দেখার অধিকার আদায় করা প্রায় অসম্ভব। মনে যতই দ্বিধা বা অনিশ্চয়তা থাকুক, এই মা একবারের জন্য নিজের চোখে দেখতে চান জান্নাতি নামের পরিচিত শিশুটিকে। তিন বছর ধরে বুকে চেপে রাখা হাহাকার ওঠে আসমার কণ্ঠে। মানবতার খাতিরেও কি একবার সে সুযোগ পেতে পারেন না?—প্রশ্ন আসমার।

হাহাকার নিয়ে বললেন, ‘একবার দেখার জন্য অনেক অনুরোধ করেছি, কিন্তু ওরা দেখতে দেননি। নিশ্চিত হলে না হয় ধারকর্জ করে টাকা জোগাড় করতাম। কিন্তু শুধু চোখের দেখা দেখার জন্য টাকা খরচের সামর্থ্য নেই। আর কোথায় গিয়ে কার কাছে কী বলতে হবে, তা-ও তো বুঝি না।’