বিলম্বিত পথে পূর্ণ রায় চেয়েছে বিএনপি

>

• সোমবার অনুলিপি না পেলে উচ্চ আদালতে প্রতিকার চাইবে বিএনপি।
• রায়ের পর নকল দিতে এতটা বিলম্ব হবে, তা চিন্তা করতে পারেননি আইনজীবীরা।
• রায় ঘোষণার সময় বিচারক বলেছিলেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা ৬৩২।

কারাগারের পথে খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি
কারাগারের পথে খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার রায়ের পর ১০ দিন পার হলেও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আপিল আবেদন করা যায়নি। কারণ, পূর্ণাঙ্গ রায়ের প্রত্যয়িত অনুলিপি বা নকল ছাড়া হাইকোর্টে আপিল করা সম্ভব নয়। ফৌজদারি আইন ও বিধিবিধান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পূর্ণ রায়ের নকল পেতে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বিলম্বিত পথ বেছে নিয়েছেন। বিধি অনুযায়ী উন্মুক্ত আদালতে যেকোনো পক্ষের আইনজীবীর অনুরোধে রায়ের পূর্ণ বিবরণ রায়দানকারী বিচারকের পড়ে শোনানো আবশ্যিক। তা ছাড়া, বর্তমান সরকারের আমলে ২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্টে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী নেওয়া হয়েছিল। সে সংশোধনীর ফলে ঘোষিত রায়ের ফটোকপি আদালত তাৎক্ষণিকভাবে অভিযুক্তকে সরবরাহ করতে পারেন। বাস্তবে এর অনুশীলনও শুরু হয়েছে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আইনের আওতায় রায় ঘোষণার দিন তাঁরা পূর্ণ রায় পড়ে শোনানোর দাবি করেননি কিংবা তার ফটোকপি চেয়ে দরখাস্ত করেননি। তিনি বলেন, ‘আমরা এটা চিন্তাও করতে পারিনি যে আদালত রায় ঘোষণার পরে নকল দিতে এতটা বিলম্ব করতে পারে।’ তবে তাঁরা মনে করেন, রায়ের অনুলিপি পাওয়াসংক্রান্ত আইন এরই মধ্যে লঙ্ঘিত হয়েছে। সোমবারও অনুলিপি না পাওয়া গেলে উচ্চ আদালতে তাঁরা এর প্রতিকার চাইবেন।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৬৬ ধারার ১ উপধারার শর্তাংশে বলা হয়েছে, রায় ঘোষণার সময় বাদী বা আসামিপক্ষ অনুরোধ করলে রায়দানকারী বিচারক সমগ্র রায় পড়ে শোনাবেন। এর অর্থ, রায় সম্পূর্ণভাবে চূড়ান্ত হওয়ার পরই কেবল বিচারক রায় ঘোষণার তারিখ দেবেন। রায় ঘোষণার পর দ্রুত তার অনুলিপি দেওয়ার এক দীর্ঘ ঐতিহ্য অধস্তন আদালতের রয়েছে। এ নিয়ে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ সেখানে মুষ্টিমেয় ও ব্যতিক্রম।

রায় ঘোষণার দিন বিচারক আদালতে বলেছিলেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা ৬৩২। তবে বাদী ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্কের সংক্ষিপ্তসার ও রায়ের কার্যকরী অংশ তিনি ঘোষণা করতে যাচ্ছেন। এ সময় আইনজীবীদের কোনো পক্ষ থেকেই এ বিষয়ে কোনো ওজর-আপত্তি তোলা হয়নি।
২০০৯ সালের ৫ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ প্রধান বিচারপতির আদেশক্রমে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছিলেন। তাতে বলা হয়, উপযুক্ত ফি নিয়ে রায়ের সত্যায়িত ফটোকপি সরবরাহ করা যাবে। ২০০৯ সালের আগে এ বিধান ছিল না। ফোলিও (মুদ্রিত সরকারি কাগজ) দিয়ে নকলের দরখাস্ত করা হলে ‘বিলম্ব ছাড়াই’ অভিযুক্তকে তা দেওয়ার কথা অবশ্য ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭১ বিধিতেও বলা হয়েছে। এই আইনি সুবিধা নিয়েও বিএনপির চার শ আইনজীবীর কেউই ফটোকপির জন্য দরখাস্ত করেননি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবেদীন সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন, আইনে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে রায়ের নকল দেওয়ার কথা বলা আছে। খন্দকার মাহবুব হোসেন অবশ্য প্রথম আলোর এক প্রশ্নের উত্তরে নিশ্চিত করেছেন, আইনের কোথাও সুনির্দিষ্টভাবে পাঁচ দিন সময়সীমার মধ্যে রায়ের নকল দেওয়ার কথা বলা হয়নি।

তবে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘এত গুরুত্বপূর্ণ মামলায় আপিল করার জন্য প্রচলিত বিধানমতে আমরা যেহেতু প্রত্যয়িত অনুলিপির জন্য আবেদন করেছি, সে বিবেচনায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে আইনি পথে আদালত নিজের পক্ষ থেকেও তাৎক্ষণিকভাবে রায়ের ফটোকপি দিতে পারতেন। সেটা না দেওয়ায় সংশ্লিষ্ট বিধানের লঙ্ঘন হয়েছে।’ দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান অবশ্য এর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘প্রার্থনা ছাড়া কোনো প্রতিকার আদালত দেন না। তাঁরা যেহেতু ফোলিও জমা দিয়েছেন, সেভাবেই তাঁদের তা পেতে হবে। আদালত এখন আর তাঁদের সত্যায়িত ফটোকপি দিতে পারবেন না।’

২০০৯ সালে ফটোকপির বিধান প্রবর্তন কমিটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অবসরপ্রাপ্ত সদস্য প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘জরুরি ভিত্তিতে কেউ রায়ের নকল পেতে চাইলে জরুরি ফি জমা নিয়ে কতগুলো ফোলিও লাগবে, নকলখানার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি সেটি নির্ধারণ করেন। ফোলিও জমা দিয়ে রায়ের কপি পেতে এভাবে অহেতুক দীর্ঘ সময় লেগে যেত। এখন কম্পিউটারের যুগ। তাই সাধারণভাবে এটাই ধরে নেওয়া হবে যে, বিচারক পূর্ণাঙ্গ রায় প্রস্তুত করেই প্রকাশ্যে আদালতে তা ঘোষণা করেছেন। তাই রায় ঘোষণামাত্রই তা বিচারকের দ্বারা স্বাক্ষরিত, এরপর তা অভিযুক্তের আবেদনক্রমে ফটোকপি হিসেবে তা সরবরাহ, এমনকি ওয়েবসাইটেও দেওয়া সম্ভব। আমরা সেই বিবেচনায় রায়ের ফটোকপি সরবরাহের বিধান চালু করি।’ সেটির ২৪০ বিধিতে রায়ের নকল ‘যথাসম্ভব দ্রুত’ দিতে বলা হয়েছে।

খন্দকার মাহবুব হোসেন স্বীকার করেছেন, রায়ের ফটোকপির বিধানটির কথা আইনজীবী প্যানেলের জানা থাকার কথা। কিন্তু ২০০৯ সালের সেই বিধানের আওতায় তাঁদের কেউ রায়ের ফটোকপি প্রার্থনা করেননি।