কারমাইকেল কলেজ: বরাদ্দ মানেই অধ্যক্ষের পোয়াবারো

কারমাইকেল কলেজে কোনো অনুষ্ঠান বা কাজে বরাদ্দ মানেই পোয়াবারো অধ্যক্ষ মো. আবদুল লতিফ মিয়ার। প্রত্যেক বরাদ্দ থেকে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নেন তিনি। বাদ যায় না বিভিন্ন জাতীয় দিবস বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বরাদ্দও। শিক্ষার্থী ভর্তিসহ কলেজের উপার্জনের খাতের বেলায়ও তাই। দেড় বছরের কম সময়ে তিনি কলেজের অন্তত দুই কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষকদের বক্তব্য, বিভিন্ন নথি ও প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এসব অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।

২০১৭ সালের মার্চ। রংপুর কারমাইকেল কলেজে নারীদের অন্তঃকক্ষ (ইনডোর) ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হবে। এ জন্য বরাদ্দ ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা। তবে ‘অডিট নিষ্পত্তি’ খরচের নামে ১০ হাজার টাকা নিয়ে নিলেন অধ্যক্ষ। সেই ঘটনার সাক্ষী কলেজের সহযোগী অধ্যাপক শামীমা আখতার। তিনি ছিলেন ওই প্রতিযোগিতা পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক।

আরও গুরুতর অভিযোগ হলো, ১৯৯৯ সালে পদোন্নতি পরীক্ষায় নকলসহ ধরা পড়েন অধ্যক্ষ আবদুল লতিফ মিয়া। নয় বছরের জন্য পরীক্ষায় বসার অযোগ্য ঘোষণা করা হয় তাঁকে। বিভাগীয় মামলাও হয়। তখন তিনি ছিলেন প্রভাষক। এত কিছুর পরও তাঁর পদোন্নতি হয়। এ বিষয়ে অধ্যক্ষ বলেন, ওই পদোন্নতি পরীক্ষায় তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছিল। তাঁকে শাস্তি দিয়েছিল সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি)। তবে পরে তা ঠিক হয়ে গেছে।

আবদুল লতিফ কারমাইকেল কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন ২০১৬ সালের ২১ নভেম্বর। এরপর কলেজের শিক্ষকদের সমন্বয়ে ৮৭টি কমিটি গঠন করে দেন। বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন, কর্মশালা, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়ন করে এসব কমিটি। এসব কমিটির অধীনে কলেজ তহবিল থেকে টাকা বরাদ্দ হয়। প্রত্যেক বরাদ্দ থেকে অধ্যক্ষ অডিট নিষ্পত্তির নামে ১০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা নেন। এ ছাড়া বিভিন্ন পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কেন্দ্র ফি নেওয়া হয়। সেই ফি থেকেও অডিট নিষ্পত্তির নামে ১০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা নেন অধ্যক্ষ।

কলেজের শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আখতারুজ্জামান চৌধুরী, ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সফিয়ার রহমান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোক্তার হোসেন বলেন, আবদুল লতিফ কারমাইকেল কলেজে যোগ দেওয়ার পর কলেজে ১৩৭টি অনুষ্ঠান হয়েছে। এসব অনুষ্ঠানে ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের বরাদ্দ থেকে এবং বিভিন্ন পরীক্ষার কেন্দ্র ফি থেকে অধ্যক্ষ কৌশলে অন্তত দুই কোটি টাকা নিয়েছেন।

এভাবে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন লতিফ মিয়া। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘কলেজে কোনো খাতে ব্যয় হলেই অডিট ফাঁক ধরে; ভুলও হয়। তাই যেখানেই কলেজের খরচ হয়, সেখানেই অডিটে নিষ্পত্তির জন্য টাকা নিতে হয়। এটা ওপেন সিক্রেট। শুনেছি, দেশে কে কোন কলেজ অডিট করবে, সেটার নাকি ডাক হয়। কাজেই অডিট বাবদ টাকা না নিলে অডিটরকে কোথা থেকে টাকা দেব? আমার বেতন থেকে টাকা দেব?’

পরীক্ষা ফিতেও ভাগ বসান

কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, কলেজে ২০১৪ সালের মাস্টার্স শেষ পর্ব পরীক্ষা কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন এ টি এম রিয়াজুল ইসলাম। ওই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ২০১৭ সালে। ওই পরীক্ষার ফি হিসেবে ওঠে ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৮০০ টাকা। অধ্যক্ষ অডিট খরচের নামে রিয়াজুলের কাছ থেকে দুই দফায় ৭৫ হাজার টাকা নেন। তিনি নিজের কার্যালয়ের আপ্যায়ন খরচের নামেও টাকা নেন। এই টাকা নিয়েছেন বিভিন্ন বিভাগের স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শ্রেণির ইনকোর্স পরীক্ষা ও মৌখিক পরীক্ষার ফি থেকে। বিভিন্ন বিভাগের প্রধানেরা সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা ফির ৫ শতাংশ অধ্যক্ষকে দিয়েছেন। এই সময়ে ১৮টি বিভাগ থেকে মোট ৪৪ হাজার ৭৯৪ টাকা নিয়েছেন। এ-সংক্রান্ত নথিগুলোতে অধ্যক্ষ সই করেছেন। নথিগুলো প্রথম আলোর হাতে আছে।

কলেজের শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক আখতারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, পরীক্ষার ফি থেকে অধ্যক্ষের আপ্যায়ন খরচ নেওয়ার কোনো বিধান নেই। কারণ, কলেজের বিবিধ তহবিল থেকে তিনি ওই খরচ পান।

তবে অধ্যক্ষ আবদুল লতিফ বলেন, ‘একজন অধ্যক্ষের দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান অনেক খরচ থাকে। কলেজের বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনকে কিছু দিতে হয়। এ কারণে আপ্যায়নের নামে টাকা নিতে হয়। তবে ৫ শতাংশ নয়; পরীক্ষার আয় থেকে বিভাগীয় প্রধানেরা আমাকে একটা থোক বরাদ্দ দেন।’

অধ্যক্ষ গত ঈদুল ফিতরের আগে (১৯ জুন) কলেজ উন্নয়ন তহবিল থেকে একটি চেকের মাধ্যমে ৫ লাখ ৫৯ হাজার ৯৪৭ টাকা তোলেন। তার আগে ১২ ও ১৮ জুন ২০ হাজার করে আরও ৪০ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন। এ অভিযোগ কলেজের সহযোগী অধ্যাপক শহিদুল ইসলামের।

এ বিষয়ে অধ্যক্ষ বলেন, ‘ওই টাকা তুলে আমি কলেজের তৃতীয় ভবনের দরজা-জানালা লাগিয়েছি।’

নির্দেশিকা বিক্রির টাকা

কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষ, স্নাতকোত্তর প্রথম ও শেষ পর্বের ভর্তি পরীক্ষার্থীদের ভর্তি নির্দেশিকা সরবরাহ করা হয়। এ জন্য শিক্ষার্থীপ্রতি নেওয়া হয় ৫০ টাকা করে। ২০১৭ সালে এই তিনটি ভর্তিতে অন্তত ১৮ হাজার কপি নির্দেশিকা দিয়ে প্রায় ৯ লাখ টাকা তোলা হয়। প্রতিটি নির্দেশিকা ছাপানোয় খরচ ১২ টাকা। সে হিসেবে কলেজের ব্যয় হয় প্রায় সোয়া দুই লাখ টাকা। বাকি টাকা অধ্যক্ষ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে আবদুল লতিফ মিয়া বলেন, ‘এই টাকার ভাগ কলেজের উপাধ্যক্ষ পায় নাই? নির্দেশিকা তৈরির কাজটি করেছে ভর্তি কমিটি। তবে প্রতিটি নির্দেশিকায় খরচ ১২ টাকা নয়; ১৮ টাকা করে পড়েছে।’

আরও অভিযোগ

রংপুর মহানগরের মাস্টারপাড়ায় অধ্যক্ষ আবদুল লতিফ মিয়ার দুটি বাড়ি রয়েছে। একটি চারতলা; অন্যটি তিনতলা। বাড়ি করতে কোনো উৎস থেকে ঋণ নেননি। এ বিষয়ে অধ্যক্ষ বলেন, ‘আমি নীতিমান মানুষ। আমার স্ত্রী রংপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ। দুজনের বেতনের টাকা এবং কৃষিজমি থেকে আয়ের টাকা জমিয়ে বাড়ি করেছি।’

শুধু রংপুরে নয়, ঢাকায় দুটি নির্মাণাধীন ফ্ল্যাট আছে আবদুল লতিফ ও তাঁর স্ত্রীর নামে। দুটিই মিরপুরে স্বপ্ননগর আবাসিক প্রকল্পে। জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের অর্থায়নে ওই প্রকল্প অবশ্য এখনো বাস্তবায়নাধীন। এ বিষয়ে লতিফ মিয়া বলেন, ‘আমরা দুজনেই সরকারি চাকরি করি। তাঁর (স্ত্রীর) যোগ্যতায় সে ফ্ল্যাট পেয়েছে; আমার যোগ্যতায় আমি পেয়েছি। এতে বিধির কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।’

কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাসে অধ্যক্ষের বসবাসের জন্য একটি সুসজ্জিত সরকারি বাসা বরাদ্দ রয়েছে। তবে আবদুল লতিফ মিয়া সেখানে থাকেন না। বাসাটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ছয়জন কর্মচারী রয়েছেন। তাঁদের পেছনে মাসে সরকারের খরচ অন্তত ৫০ হাজার টাকা।

এ বিষয়ে অধ্যক্ষ বলেন, ‘বাসাটি বাইরে থেকে দেখতে সুসজ্জিত মনে হলেও সাপের ভয় আছে। আমার ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকতে চায় না।’

মোছা. সাবিহা নাম দিয়ে চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারীর নামে অধ্যক্ষ প্রতি মাসে কলেজ তহবিল থেকে সাত হাজার করে টাকা তুলছেন। কিন্তু এই নামে কলেজের কোনো কর্মচারী নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবদুল লতিফ বলেন, ‘সাবিহা আমার বাসায় কাজ করে। আমি বেগম রোকেয়া কলেজে থাকাকালেও এভাবে একজনের নামে টাকা নিয়েছি। বাসায় কাজ করলে তাঁকে টাকা দিতে হবে না? বিনা বেতনে কেউ কাজ করবে?’

কারমাইকেল কলেজের শিক্ষকেরা অভিযোগ করেন, এখানে আসার আগে রংপুর সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজেও তিনি অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন। এ–সংক্রান্ত অডিট আপত্তিতে দেখা যায়, বেগম রোকেয়া কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালে আবদুল লতিফ মিয়া ১ লাখ ৪৩ হাজার ৭০৫ টাকা বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়েছেন। সেটা ছিল বিভিন্ন পরীক্ষার কেন্দ্র ফির টাকা। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে ওই কলেজে অন্তত ১০টি পরীক্ষার নামে ১ লাখ ৭৪ হাজার ৯ টাকার অডিট আপত্তি উঠেছে।

এ বিষয়ে অধ্যক্ষ বলেন, ‘আরও বেশি অডিট আপত্তি দিয়েছে সফিকুর (অডিটর)। সব খাতে অডিট আপত্তি দিয়েছে। তুমি কী করবা? টাকা না পেলে সবকিছুতেই আপত্তি দেয়। লোকটা মরে গেছে।’

অধ্যক্ষবিরোধী আন্দোলন

অধ্যক্ষের অপকর্মের বিচার চেয়ে ও তাঁর অপসারণের দাবিতে কলেজের শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা ১০ ফেব্রুয়ারি ক্লাস বর্জন করে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি ক্লাস বর্জন কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন। ওই দিন থেকে অধ্যক্ষের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি চলছে। গতকাল শনিবারও তাঁরা কর্মসূচি পালন করেন।