চিকিৎসকের বিকল্প তৈরি হচ্ছে!

স্বাভাবিক কাজকর্মের জন্য শারীরিক সুস্থতা জরুরি। সৃষ্টির পর থেকে মানবদেহের অসুস্থতা ও তা নিরাময়ের পথ মানুষ নিজেই খুঁজে নিয়েছে। ধাপে ধাপে নানা বাঁকে এগিয়ে চিকিৎসাব্যবস্থা আজকের পর্যায়ে পৌঁছেছে। কী সেই বাঁকগুলো, কত দূরইবা এগিয়েছে আধুনিক চিকিৎসা—লন্ডনভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে প্রতিবেদনের তৃতীয় ও শেষ পর্ব

ডিজিটাল স্বাস্থ্যব্যবস্থা
ডিজিটাল স্বাস্থ্যব্যবস্থা

ডিজিটাল স্বাস্থ্যব্যবস্থা চিকিৎসার দুনিয়ায় সত্যিই বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সন্দেহ নেই। কিন্তু এটা মাথায় রাখা দরকার যে পুরোনো চিকিৎসা ব্যবস্থার গুরুত্ব অচিরেই ফুরিয়ে যাচ্ছে না। অ্যাপলের একটি ঘড়ি বা স্মার্টফোন আপাতত এমআরআই অথবা এক্স-রের গুরুত্ব প্রতিস্থাপন করতে পারছে না। এমআরআই বা এক্স-রে আজকের দিনে এসেও যথেষ্ট কার্যকরী। আর এ ধরনের কিছু অ্যানালগ প্রযুক্তির ডিজিটাল ভাষা প্রক্রিয়াকরণ এখনো বেশ জটিলই। তারপরও স্বাস্থ্য-বিষয়ক হালনাগাদ তথ্য জানতে চিকিৎসকের দরজায় কড়া নাড়বার প্রয়োজনটি নিঃসন্দেহে সংকুচিত হচ্ছে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায়।

অ্যালফাবেট স্বাস্থ্যসেবা ব্যবসায় যাত্রা করেছিল ভেরিলি ও ডিপমাইন্ডের মাধ্যমে। ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে অ্যালফাবেট ইতিমধ্যেই গড়ে তুলেছে চিকিৎসাসেবার বিরাট বাজার। সেখানে চারটি বড় হাসপাতালের সঙ্গে অংশীদারত্ব রয়েছে ডিপমাইন্ডের, যেখানে স্ট্রিম নামে একটি অ্যাপ সরবরাহ করছে প্রতিষ্ঠানটি। এই অ্যাপের মাধ্যমে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য তথ্য বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে প্রয়োজনীয় সতর্কবার্তা দেওয়া যায়। একইভাবে ভেরিলি কাজ করছে মার্কিন জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থার (এনএইচএস) সঙ্গে। গত বছরের মে মাসে আমেরিকার এনএইচএস হেউড, মিডলটন ও রোশডেল ক্লিনিক্যাল কমিশনিং গ্রুপের জন্য তথ্য বিশ্লেষণে নিজেদের সংযুক্ত করে প্রতিষ্ঠানটি। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত প্রক্রিয়াজাত করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সম্ভাব্য রোগ সম্পর্কে দ্রুততার সঙ্গে সতর্কতা দিতে সক্ষম ভেরিলি। একইভাবে গত সেপ্টেম্বরে কেমব্রিজে নিজেদের উদ্ভাবিত অ্যালগরিদম ব্যবহার করে রোগীদের তথ্য বিশ্লেষণে মাইক্রোসফটও নিজেদের ডিজিটাল চিকিৎসাসেবা চালু করেছে।

অ্যাপলের ঝোঁক মূলত চিকিৎসায় নতুন যন্ত্র উদ্ভাবন। চিকিৎসা উপাত্ত বিশ্লেষণে আইফোনের উপযোগী তৃতীয় পক্ষের অ্যাপ তৈরির জন্য তরুণ উদ্ভাবকদের উৎসাহ দিয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। এরই মধ্যে এ ক্ষেত্রে অনেকেই এগিয়ে এসেছে। ফলে আইফোনের পর্দাতেই এখন রোগের সব রিপোর্ট পাওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘সেজ বায়োনেটওয়ার্কস’র তৈরি বিশেষ অ্যাপ ‘এমপাওয়ার’র কথা উল্লেখ করা যায়। পারকিনসন্স রোগীদের জন্য এই অ্যাপ বানানো হয়েছে। এই অ্যাপ আইফোনের অভ্যন্তরীণ ত্বরক যন্ত্র (এক্সেলেরেটর) ব্যবহার করে রোগের তীব্রতা মাপাসহ চিকিৎসকের মতোই করণীয় বলে দিতে সক্ষম। এ ছাড়া এই অ্যাপের মাধ্যমে পারকিনসন্স রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগেই তা শনাক্ত করতে পারবেন চিকিৎসকেরা।

তথ্যপ্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গার্টনার’র স্বাস্থ্যসেবা বিশ্লেষক অনুরাগ গুপ্ত লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ইকোনমিস্টকে বলেন, এই সব ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে অ্যাপলের রাজস্বে বিপুল পরিমাণ অর্থ যোগ হবে সন্দেহ নেই। অচিরেই চিকিৎসকেরা ও ইনস্যুরেন্স কোম্পানিগুলো অ্যাপলের এসব প্রযুক্তি তাদের পরিষেবাতেও যুক্ত করবেন।

এখানেই শেষ নয়, রোগনির্ণয়ে প্যাথলজি ও প্রচলিত ওষুধের বিকল্প হিসেবে হাজির হয়েছে রোগের অ্যালগরিদম ও ডিজিটাল ওষুধ ব্যবস্থা। রোগের অ্যালগরিদম হলো রোগ নির্ণয়ের জন্য ডিজিটাল ভাষা, যা বিভিন্ন ডিভাইসের সফটওয়্যার বা অ্যাপে কোড করা থাকবে। এর কথা এই লেখার পূর্বের আলোচনায় কিছুটা এসেছে। আর, ডিজিটাল ওষুধ ব্যবস্থা বলতে প্রচলিত ওষুধ পরিহার করে ডিজিটাল প্রযুক্তিকেই ওষুধের বিকল্প করা। তবে, সব রোগেরই ডিজিটাল ওষুধ সম্ভব কিনা তাও ভাবা হচ্ছে। আপাতত অভ্যাস জনিত রোগ যেমন– ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, মানসিক রোগের চিকিৎসায় ডিজিটাল ওষুধ কার্যকরি বলে গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে। নতুন এই ওষুধ ব্যবস্থাকে ‘ডিজিসিউটিক্যালস’ বলা হচ্ছে।

এখানে, বড় পরিসরে আমাজনের উদ্যোগ লক্ষ্য করার মতো। আমাজন তার ডেটা প্রসেসিং ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে হাসপাতাল ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে রোগীদের স্বাস্থ্য প্রতিবেদন ব্যক্তিগত কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের পর্দায় দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে। কেউ ভেবেছিল, আমাজনের উদ্যোগটি হয়তো ডাক্তারদের সঙ্গে রোগীর অগ্রিম অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করার মতো কিছু করবে। কিন্তু রেস্তোরাঁর টেবিল বুক করার মতো সহজ চিন্তাপ্রসূত প্রকল্পের পথে হাঁটেনি আমাজন। তারা প্রাথমিকভাবে নিজেদের প্রায় ১০ লাখ কর্মীর জন্য চিকিৎসকের বিকল্প এই ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা সীমাবদ্ধ রাখছে। অচিরেই এটি সাধারণের জন্যও চালু করা সম্ভব হবে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থাতেই ডিজিটাল প্রযুক্তি সন্নিবেশিত করতে অ্যালফাবেটের উদ্যোগের কথা বলা যায়। অ্যালফাবেটের সিটিব্লক হেলথের লক্ষ্য নিম্ন আয়ের নগরবাসীর জন্য বাড়ি বাড়ি চিকিৎসক পাঠানো। এই চিকিৎসকের খরচ রোগীকে দিতে হবে না, সেটি দেবে এই প্রকল্পের আওতায় থাকা ইনস্যুরেন্স ব্যবস্থা। এ জন্য প্রকল্পের সঙ্গে আমেরিকার অন্যমত বড় স্বাস্থ্যবিমা কোম্পানি ‘মেডিকেইড’কে যুক্ত করেছে অ্যালফাবেট।

অ্যাপলের স্মার্টওয়াচ এরই মধ্যে অনেকটা অগ্রসর হয়েছে। এখন বিভিন্ন ডিভাইসে ক্যামেরার চারপাশে অসংখ্য সেন্সর সন্নিবেশিত করছে অ্যাপল। রোগীর রক্তচাপ, চর্বির পরিমাণ ও হৃৎস্পন্দন নির্ণয়ের জন্য পর্দায় একটি আঙুল রাখলেই আইফোন সব বলে দেবে সেদিন আর খুব বেশি দূরে নয়। তারহীন হেডফোন এয়ারপডকেও আগামী দিনে বায়োমেট্রিক মনিটরিংয়ের কাজে লাগানোর মতো করে প্রস্তুত করছে অ্যাপল। এ ছাড়া স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যৌথ গবেষণায় অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন নির্ণয়ের অ্যালগরিদম প্রস্তুতে সক্ষম হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এই গবেষণা ‘ডিজিটাল থেরাপিউটিক’ নামে একটা নতুন চিকিৎসাব্যবস্থার দরজা খুলে দিচ্ছে। নতুন এই চিকিৎসা ব্যবস্থার আইনগত প্রক্রিয়া এখন আমেরিকার সরকারি অনুমোদনের দ্বারপ্রান্তে।

ভেরিলির নতুন যন্ত্র উদ্ভাবন প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে সার্জিক্যাল রোবোট। এটি অপারেশন থিয়েটারে চিকিৎসকের মতোই নিখুত অস্ত্রোপচার করতে পারবে। এতে বিনিয়োগ করছে ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জনসন অ্যান্ড জনসন। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি চিকিৎসা সরঞ্জাম তৈরির প্রতিষ্ঠান ডেক্সকম ও ওষুধ কোম্পানি সানোফির সঙ্গে মিলে ডায়াবেটিস চিকিৎসায় নতুন প্রযুক্তি আনছে। এই জন্য ভেরিলি চার বছর ধরে ১০ হাজার মানুষের তথ্য নিয়ে গবেষণা করবে।

মানসিক চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা করছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ফেসবুক। ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে মানসিক চিকিৎসা দিতে ‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল’ তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গত বছরের নভেম্বরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইনে মানুষের আচরণ বিশ্লেষণ করে ফেসবুক। এই বিশ্লেষণ থেকে প্রাপ্ত ফলাফল মানসিক হতাশাগ্রস্ত থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা রোধ করবে বলে দাবি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

এবার ফাঁকা আওয়াজ নয়
প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলি এর আগেও স্বাস্থ্যসেবায় ডিজিটাল বিপ্লব আনার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু সেসব ফাঁকা আওয়াজ হয়ে থেকেছে। লোক হতাশ হয়েছে। গুগল ২০০৮ সালে লোকের চিকিৎসা তথ্য সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিল, যা ২০১১ সালে এসে বন্ধ হয়ে যায়। একইভাবে মাইক্রোসফটের এ ধরনের উদ্যোগও বাস্তবায়ন হয়নি। কিন্তু এবার দৃশ্যপট আলাদা। কারণ দশ বছর আগেও স্মার্টফোনকে কেন্দ্র করে স্বাস্থ্য তথ্য বিশ্লেষণের কথা চিন্তা করা যেত না, যা এবারের উদ্যোগের অন্যতম মূল শক্তি।

স্বাস্থ্য খাতে আমেরিকাসহ অন্য ধনী দেশগুলোর বাজেট বেড়েছে। জনসাধারণও একমত, ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে উচ্চ মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারলে স্বাস্থ্যসেবা খরচ কমানো সম্ভব। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য নিয়ন্ত্রণ ও প্রক্রিয়াজাত করার সক্ষমতা এখন সায়েন্স ফিকশনের মতো করে কল্পনাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে এ ক্ষেত্রে এবার সাফল্য আসবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

সার্চ ইঞ্জিন ব্যবসার বাইরে গুগল ও সামাজিক যোগাযোগের বাইরে ফেসবুকের স্বাস্থ্যসেবা খাতে এবার অবধারিত উত্থান ঘটতে যাচ্ছে। ডিপমাইন্ড ব্রিটেনে যা করে দেখিয়েছে, তাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নও ডিজিটাল স্বাস্থ্যপ্রযুক্তির ব্যাপারে এবার সত্যিই নড়েচড়ে বসছে। আমাজনের এই খাতে বিপুল বিনিয়োগের ঘটনায় স্বাস্থ্য খাতেও আগামী দিনে প্রযুক্তি ব্যবসার মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিযোগিতা শুরুর আবহ ছড়াচ্ছে। অ্যাপলের এই খাতে আদাজল খেয়ে নামা প্রযুক্তি জায়ান্টদের স্বাস্থ্য খাতে লড়াইয়ের সম্ভাবনা পাকাপোক্ত করছে জনমনে।

তবে দুশ্চিন্তাও রয়েছে। এর মধ্যে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা হারানোর শঙ্কাটিই সবচেয়ে বড়। রয়েছে আরও আশঙ্কা। মানুষ ভাবছে, প্রতিযোগিতার কারণে প্রযুক্তি ব্যবসার মতো স্বাস্থ্য খাতেও ‘তাড়াহুড়া’ ও ‘চমক’ দেখাতে গিয়ে ইঁদুরদৌড়ে নেমে পড়ে কিনা কোম্পানিগুলো। তাতে গুণমানের হেরফের হলে এবার যে স্মার্টফোন নয়, রোগীর জীবন-মৃত্যু জড়িত, সে কথা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর মাথায় থাকবে তো? (শেষ)