বাংলার পাশে, বাংলাদেশের পাশে

হান্স হার্ডার
হান্স হার্ডার

বঙ্গবিদ্যাচর্চায় নিবেদিত জার্মান পণ্ডিত হান্স হার্ডার এবং বান্ধব হান্স সম্পর্কে কিছু বলাটা মিলেমিশে জড়িয়ে-জাবড়িয়েই নিবেদন করতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ভারতীয় সাহিত্য অধ্যয়ন করছেন, একজন জার্মান হিসেবে তাঁর এই কাজে অবশ্যই অভিঘাত ফেলে জার্মান জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক বিচার। তাঁর বঙ্গবিদ্যাচর্চা নিঃসন্দেহে এক জার্মানের দৃষ্টিতে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাহিত্যের বিচার, কিন্তু এই উদ্ভাসন অন্য আলোয় নিজেকে দেখার বড় সুযোগ বটে। এর তাত্ত্বিক দিকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ব্যক্তি হান্সের পরিচয়, যা আমি লাভ করেছিলাম কবে কখন কীভাবে ভালো করে মনে নেই। তবে প্রথম সাক্ষাতের মুহূর্ত থেকে তাঁর গুণমুগ্ধ হই এবং সেই মুগ্ধতা ও বন্ধুতা তারপর থেকে অব্যাহতভাবে আমাকে জুগিয়ে চলেছে আনন্দ ও উপলব্ধি।

ফ্রাংকফুর্ট নিবাসী রোকেয়া রোথের সুবাদে হান্সের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। তরুণ এই জার্মান তখন ঢাকায় এসেছিলেন বাংলাদেশ এবং বিশেষভাবে লোকসংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষে তিনি সে সময় সবে গবেষণা সমাপ্ত করেছেন বঙ্কিমচন্দ্রের নব্য-হিন্দুবাদ বিষয়ে, নিজের মতো করে ঘুরে বেড়িয়েছেন এ দেশে, বাংলা বলেন চমৎকার আর মিশতে পারেন সবার সঙ্গে, একান্ত আন্তরিকভাবে। ফলে হান্সের ঘোরাফেরায় ছিল স্বাচ্ছন্দ্য এবং মেলামেশায় সর্বজনগামিতা। হান্স তাঁর অধ্যয়নের বিষয় খুঁজে ফিরছিলেন, ইতিপূর্বে যোগ দিয়েছিলেন হালে বিশ্ববিদ্যালয়ে, বইপত্রও অনেক সংগ্রহ করেছিলেন ঢাকা থেকে, যার মধ্যে বিশেষভাবে তাঁর মনোযোগ কেড়েছিলেন কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।

এরপর ফিরে ফিরে বাংলাদেশে এসেছেন হান্স। একবার ধানমন্ডির নিদমহল হোটেলে রাত্রিবাসের অভিজ্ঞতার পর জানালেন ছারপোকার কামড়ে তিনি অতিষ্ঠ বোধ করছেন, আমাদের বাসায় থাকতে পারবেন কি না। যথারীতি তিনি এলেন, আড্ডায়-আলোচনায় দিনগুলো কাটল চমৎকার। লুঙ্গি পরে সোফায় পা ভাঁজ করে বসে তিনি যখন গল্পে মশগুল হন, তখন বাঙালি সমাজের সঙ্গে তাঁর একাত্মতা নিবিড়ভাবে অনুভব করা যায়। তবে এহো বাহ্য, ভেতরে ভেতরে হান্স জার্মান পণ্ডিতই বটে, খুঁজে ফিরছেন তত্ত্বানুসন্ধানের নিজস্ব ক্ষেত্র। লোকসমাজের সংস্কৃত-অধ্যয়নে তাঁর প্রসারিত নজর বুঝতে পারি একবার হালে শহরে তাঁর আবাসে অবস্থান করে। দেখি তাঁর বাংলা বইয়ের বিশাল সংগ্রহ, যেখানে সাহিত্যের ভারিক্কি গ্রন্থ ছাড়াও রয়েছে মারফতি বা বৈষ্ণবীয় গানের চটি বই। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কক্ষে দেখি সাঁটা আছে বাংলা বাণিজ্যিক ছবির বিরাট পোস্টার, বাজারি মাল হিসেবে আমরা যার কোনো কদর করব না।

এরপর একবার হান্স এসে সোজা চলে গেলেন চট্টগ্রাম, মাইজভান্ডরির মাজারে, মাসখানেক অবস্থান করে ফিরলেন রুগ্‌ণ দেহে, আক্রান্ত হয়েছিলেন জন্ডিসে। তিনি বললেন, মাইজভান্ডারি-দর্শন ও সংগীত নিবিড়ভাবে বোঝার চেষ্টা করেছেন তিনি, জেনেছেনও অনেক কিছু, কিন্তু কিছুতেই যেন ভেতরে ঢুকতে পারছেন না। পরে অবশ্য ভেতরে ঢোকার চাবিকাঠি তিনি পেয়েছিলেন আবদুল গফুর হালীর কাছে, তাঁর আস্তানায়ও যাতায়াত করেছেন কয়েক দফা, জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে মাইজভান্ডারি দর্শন ও আবদুল গফুর হালীবিষয়ক তাঁর দুই গবেষণামূলক প্রতিবেদন।

হালে থেকে পরে তিনি যোগ দেন তাঁর নিজ বিদ্যাপীঠ ঐতিহ্যবাহী হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটে এবং কালক্রমে এর পরিচালক পদে বরিত হন। এই পর্যায়ে ২০১১ সালে হান্স হার্ডারের উদ্যোগে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলে ‘বাংলাদেশ গণহত্যা এবং এর বিচার’বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে সেখানে। সম্মেলনের জন্য আর্থিক সংগতি বিশেষ ছিল না, কিন্তু দক্ষিণ এশীয় ইনস্টিটিউট ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়েছিল এবং ইউরোপীয় অনেক অধ্যাপক ও বিশেষজ্ঞ নিজ উদ্যোগে সেখানে সমবেত হয়েছিলেন। এই সম্মেলন বাংলাদেশের সঙ্গে হান্সের সম্পৃক্তির আরেক বার্তা মেলে ধরে।

হাইডেলবার্গে হান্স হার্ডার নানা ধরনের গবেষণামূলক কাজ করে চলেছেন, এর বিভিন্ন প্রকাশ তাঁর তাত্ত্বিক ও পর্যালোচনামূলক নিবন্ধাদিতে প্রকাশ পেয়েছে। এখানে দুটি লেখার উল্লেখ আমি করতে পারি, যার একটি আল্লামা মুহম্মদ ইকবালবিষয়ক, জার্মান ভাষায় প্রকাশিত (২০১১) এক সংকলনে তিনি লিখেছেন পারসিক ও আরবদের ইকবাল কোন দৃষ্টিতে দেখেছেন তা নিয়ে। উর্দু, হিন্দি ও ফারসি ভাষায় দখল নিয়ে তিনি বিষয়ের যে গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন তার তুলনা পাওয়া ভার। প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘হেজি অ্যারিয়ান মিস্টিসিজম অ্যান্ড দ্য সেমিটিক ডেজার্ট সান’। বোঝা যায়, পারসিক ও সেমিটিক দ্বন্দ্বের নিরিখে ইসলাম ও ইকবাল হয়েছিল তাঁর বিশ্লেষণের বিষয়।

২০০৪ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত হালের বিশ্ববিদ্যালয়ে হান্স হার্ডার গবেষণা দল পরিচালনা করেন জাতীয়বাদী আদর্শ ও দক্ষিণ এশীয় ইতিহাসতত্ত্ব নিয়ে। সেখানে তাঁর নিজের পর্যালোচনার বিষয় ছিল ইংরেজি ভাষায় রচিত ভারতীয় সাহিত্য কতটুকু জাতীয়, তার বিচার। তিনি সব সময় বিষয়কে মোকাবিলা করেন সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে, যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে এসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ব-বঙ্গবিদ্যা সম্মেলনে মূল ভাষণ তিনি প্রদান করেছেন ‘বাংলা সাহিত্যে জাদুবাস্তব’ বিষয়ে। ভাষণে পাশ্চাত্য ও লাতিন সাহিত্যের পাশাপাশি মহাশ্বেতা দেবীর টেরোড্যাকটিলস, নবারুণ ভট্টাচার্যের হার্বাট, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা, শহীদুল জহিরের সে রাতে পূর্ণিমা ছিল এবং অংশুমান করের চে ও কলাবতী উপন্যাস নিয়ে সংক্ষিপ্ত কিন্তু তির্যক মন্তব্য পেশ করেন তিনি। উপসংহারটুকুই এখানে উদ্ধৃত করি। হান্স তাঁর অননুকরণীয় বাংলায় বলেছেন:

‘বাংলা জাদুবাস্তবের যে ব্যাখ্যাগুলো আমি একটু আগে আলোচনা করেছি, সেগুলো নিয়ে আমার একটা খটকা আছে। আমি এক শ বার মানি যে ইউরোপের উপনিবেশবাদের সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশে এবং বিশ্বজুড়েই বোঝাপড়া করা দরকার ছিল, দরকারটি এখনো আছে। কিন্তু তাই বলে যে ইউরোপকে পুরো যুক্তিবাদী, বহির্মুখী, যান্ত্রিক আর একরৈখিক হতে হবে, তা মেনে নেওয়া মুশকিল। ইতিহাসে তো বটেই, বর্তমান কালেও ইউরোপের ঘাড়ে অনেক ভূত চেপে রয়েছে, যাদের বাইরে থেকে একায়তনিক আর রৈখিক দেখাতে পারে কিন্তু যাদের প্রাণসত্তা বেশ জটিল।’

সব শেষে তাঁর ভাষ্য, ‘আমার মতে জাদুবাস্তব লিখনশৈলীর ইতিহাস এ কথা প্রতিপন্ন করে যে কোনো কোনো সাহিত্যিক আন্দোলন আন্তর্জাতিক সীমানা মানে না, এমনকি পূর্ব-পশ্চিম উত্তর-দক্ষিণও মানে না। এমন প্রকরণের বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে যাওয়াটা পণ্যায়নের ফল না সৃজনশীল একটা বিস্ফোরণ, নাকি একাধারে দুটোই, সে কথা বলা কঠিন। শুধু এ কথাই বলা যায় যে বাংলা গদ্য সাহিত্যে জাদুবাস্তববাদ নতুন প্রেরণা ও সন্দীপন এনেছে।’

এমন তির্যক বক্তব্যে কিছুটা হলেও চেনা যায় হান্স হার্ডারকে, যিনি সব সময় উসকে দেন নতুন ভাবনা।

 হান্স হার্ডার, জার্মানি

উল্লেখযোগ্য কাজ

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’স শ্রীমদ্ভগবৎগীতা: ট্রান্সলেশন অ্যান্ড অ্যানালিসিস

মাইজভান্ডারি নিয়ে জার্মান ভাষায় তিনিই প্রথম গবেষক। এ বিষয়ে তাঁর বই সুফিজম অ্যান্ড সেইন্ট ভেনারেশন ইন কনটেমপোরারি বাংলাদেশ: দ্য মাইজভান্ডারিজ অব চিটাগাং

উনিশ শতকের বাংলা গদ্যসাহিত্যসহ বাংলাদেশের আধুনিক কথাসাহিত্যও জার্মান ভাষায় স্থান করে নিচ্ছে তাঁর হাত ধরে

জার্মান ভাষায় রবীন্দ্রনাথের গল্প ‘কাবুলিওয়ালা’সহ অনুবাদ করেছেন হাসান আজিজুল হকের গল্পও