উত্তরখান থানার প্রতি চার মামলার তিনটিই মাদকের

• উত্তরখান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে নতুন অন্তর্ভুক্ত।
• উত্তরখানে গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে।
• অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা নিষ্ক্রিয়।
• উত্তরখান থানার ওসি হেলাল উদ্দিন এই অভিযোগ মানতে চাননি।

রাজধানীর উত্তরখান থানায় গত এক বছরে যত মামলা হয়েছে, তার ৭১ শতাংশ বা প্রতি চার মামলার তিনটিই মাদকদ্রব্য-সংক্রান্ত। এ তথ্য দিয়েছেন উত্তরখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিজেই। এলাকার এক বাসিন্দা মামলার এ সংখ্যা উল্লেখ করে বলেন, এই হিসাবই বলে দেয়, এলাকায় মাদকের ভয়াবহতা কী রকম।

উত্তরখানে গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে। কোনো কিছুতেই রাখঢাক নেই। অভিযোগ রয়েছে, সেখানে মাদক নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা একেবারেই নিষ্ক্রিয়।

তবে উত্তরখান থানার ওসি হেলাল উদ্দিন এ দাবি মানতে চাননি। মাদক সমস্যার কথা স্বীকার করে বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে উত্তরখান থানার পুলিশ
নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে।

উত্তরখান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে নতুন অন্তর্ভুক্ত। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এই এলাকার বেশির ভাগই নতুন বসতি। গত শনিবার এলাকার কাচকুড়া, মৈনারটেক, চামুরখান, নোয়াখোলা, ভাতুরিয়া, বেতুলি, বাওথার, গোবিন্দপুর, দোবাদিয়া, মাউছাইদ গ্রাম ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই এলাকার প্রধান সমস্যা হলো মাদক। তাঁরা জানান, উত্তরখানে মাদক ব্যবসা করেন মাস্টারপাড়া শাহি মসজিদ এলাকার লিজা, মাদারবাড়ির (ভূঁইয়াবাড়ি) সোহেল, সোহান, সাব্বির, কাচকুড়ার রুবেল, উত্তরখানের জহির, উত্তরখান শাহ্ কবীর মাজার এলাকার কালা মানিক ও তাঁর ছেলে কালা সজিব এবং সহযোগী শামীমসহ আরও অর্ধশতাধিক, মৈনারটেকের তমু, দোবাদিয়ার মাদকসম্রাট মাইনুদ্দিন এবং চামুরখানের মাদক ব্যবসায়ী দেলোয়ার ওরফে বাগের দেলোয়ার। পুলিশ তাঁদের নাম জানে, চেনেও। কিন্তু গ্রেপ্তার করে না।

পুলিশ জানায়, উত্তরখান থানার পুলিশের তালিকায় ৪৩ জন মাদক ব্যবসায়ীর নাম আছে। যার মধ্যে ২১ জন পুলিশ তালিকায় চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। অন্য ২২ জন নতুন। তাঁদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

স্থানীয় লোকজন জানান, উত্তরখানের মাজার এলাকার আশপাশে প্রকাশ্যে মাদক কেনাবেচা চলে। সন্ধ্যা হলেই বসে গাঁজার আসর। মাদকসেবীরা সেখানে জড়ো হয়ে মাদক সেবন করেন। মাজার এলাকায় মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন কালা মানিক ও তাঁর ছেলে কালা সজিব। তাঁদের দলে ৫০ জনের বেশি মাদক ব্যবসায়ী। তাঁরা মাদক পরিবহনের কাজ করে থাকেন। মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে মাদক পৌঁছে দেওয়া হয়।

উত্তরখানের পাশে আছে বালু, তুরাগ ও নলি নদ এবং রং বাইগার খাল। কুমুদ খোলা, মুন্ডা, মাউছাইদ এলাকায় পারাপারের জন্য আছে খেয়াঘাট। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, এই এলাকায় অধিকাংশ মাদক চালান আসে নদীপথে। বিশেষ করে টঙ্গী, কালীগঞ্জ এবং রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে মাদক আসে। এ ছাড়া মাদকসেবীরা নিজেরাও নদী পার হয়ে টঙ্গী থেকে মাদকদ্রব্য নিয়ে আসেন।

মৈনারটেকের বাসিন্দা রবিউল ইসলাম বলেন, মাদক ব্যবসায়ীদের লক্ষ্য যুবকদের আড্ডাস্থল। তাঁরা সেখানে মাদক বিক্রি করেন। তাঁর দাবি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয় ভূমিকার কারণেই উত্তরখানে মাদক ব্যবসার প্রসার ঘটছে।

স্থানীয় লোকজন জানান, উত্তরখানের মাদক ব্যবসায়ীরা খুচরা বিক্রেতা। পাইকারি বিক্রেতারা পার্শ্ববর্তী টঙ্গী এলাকার। সেখান থেকেই মাদকের মূল চালান আসে। পানিপথে, সড়কপথে কখনো আবার কালীগঞ্জ, উলুখোলা ঘুরেও উত্তরখানে মাদক ঢোকে।

মাউছাইদের সেলিনা খান বলেন, উত্তরখানে এখন ইয়াবাসেবীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। ছেলেমেয়েরাও হাতের দুই আঙুলের ফাঁকের মধ্যে এই নেশাদ্রব্য লুকিয়ে রাখে।

উত্তরখানের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন বলেন, পুলিশ সক্রিয় হলে এমন অবাধে মাদক বিক্রি সম্ভব হতো না।

উত্তরখান থানার পুলিশ জানিয়েছে, এই থানায় ২০১৭ সালে মামলা হয়েছে ২১৪টি। এর মধ্যে মাদকের মামলা ১৫২টি। এই হিসাবে ৭১ শতাংশই মাদকের মামলা। পুলিশের হিসাবে, গত বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে মাদক আইনে গ্রেপ্তার হয়েছেন ১০৭ জন। এর মধ্যে ৪ জন নারী। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বেশির ভাগই ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ ধরা পড়েছেন।