নিরাময় কেন্দ্রেরই চিকিৎসা দরকার

ভেতরে ঢুকতেই বিশ্রী গন্ধ এসে নাকে লাগে। অপরিচ্ছন্ন দেয়াল, মেঝেতে পুরোনো ময়লা। শৌচাগার থেকেও উপচে পড়ছে ময়লা। এই হলো ঢাকার কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের অবস্থা। এই কেন্দ্রের পাশের ভবনটিতে বসেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও পদস্থ কর্মকর্তারা।
শুধু ঢাকার এই কেন্দ্রটিই নয়, ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় যে তিনটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে আছে, সেখানকার অবস্থাও ভালো নয়। অবকাঠামো নেই, রোগী নেই, প্রয়োজনীয় চিকিৎসক নেই, ভালো পরিবেশও নেই। সব মিলে দুরবস্থা বাসা বেঁধেছে সেখানে।

মাদকবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হেলালউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিরাময় কেন্দ্রের দুরবস্থার কথা আমরা আগে থেকেই জানি। সবার আগে নিরাময় কেন্দ্রেগুলোরই চিকিৎসা দরকার।’

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ জামালউদ্দীন আহমেদ বলেছেন, তাঁদের প্রয়োজনীয় লোকবল নেই বলে এই দুরবস্থা হচ্ছে। লোকবল নিয়োগ ও কিছু যন্ত্রপাতি কেনা হলে কেন্দ্রগুলোতে কোনো সমস্যা থাকবে না। তবে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, এই অধিদপ্তরে গত ২৭ বছরে ৩২ জন মহাপরিচালক বদলি হয়েছেন। যোগ দিতে না-দিতে বদলি হওয়া মহাপরিচালকেরা কিছুই করতে পারেন না।

দেশে প্রতিবছরই মাদকের ব্যবহার বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে মাদকসেবীর সংখ্যা। মাদকের বাজার ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি বলে ধরে নেওয়া হয়। সিআইডির ফরেনসিক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের কমান্ড্যান্ট শাহ আলম তাঁর গবেষণায় বলেছেন, ২০১০ সালে দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ছিল ৪৬ লাখ, বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৬৬ লাখে। এর মধ্যে ১৫ বছরের বেশি বয়সের মাদকসেবী আছে ৬৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। এতে করে প্রতি ১৭ জনে একজন তরুণ মাদকাসক্ত বলে ধরে নেওয়া যায়। তিনি বলেন, মাদকসেবী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাদকের বাজারও বিস্তৃত হচ্ছে। শহর থেকে তা গ্রাম-গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে।

জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইউএনওডিসির মতে, মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের প্রতি দশজনে একজন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে। এই সত্য ধরে নিলে ৬৬ লাখে রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ লাখ ৬০ হাজার। কিন্তু চারটি সরকারি নিরাময় কেন্দ্র এবং ২০৯টি বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্র মিলে চিকিৎসার সুবিধা আছে পাঁচ হাজারের মতো। বাকি মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা থাকছে চিকিৎসাসেবার বাইরে। অধিদপ্তর সূত্র বলেছে, গত বছরে তেজগাঁওয়ের কেন্দ্রীয় নিরাময় কেন্দ্রসহ চারটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ১৪ হাজার ৬৮৮ জন মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

তেজগাঁওয়ে কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের প্রধান পরামর্শক সৈয়দ ইমামুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নিরাময় কেন্দ্রে ২৮ দিন চিকিৎসা দেওয়ার পর মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি হওয়া জরুরি। কিন্তু পুনর্বাসন কেন্দ্রে জায়গা না থাকায় অনেক মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে বাড়ি ফিরে যেতে হচ্ছে।

সরেজমিন তেজগাঁও নিরাময় কেন্দ্র
কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র তেজগাঁওয়ে গিয়ে জানা গেল, মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা হৃদ্রোগসহ অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত কি না তা নির্ণয়ের জন্য এক্স-রে ও ইসিজি, ডায়াবেটিস, কিডনি ও ভাইরাল হেপাটাইটিস এ বি সি পরীক্ষা করার দরকার হয়। কিন্তু এসব পরীক্ষার কোনো যন্ত্রপাতি নেই। টেকনোলজিস্টও নেই। ফলে এখানে আসা মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের বাইরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পাঠানো হয়। এ ছাড়া নারীদের চিকিৎসা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থাই নেই। গত বছরে এ কেন্দ্র থেকে নিরাপত্তাকর্মীদের বেঁধে একসঙ্গে কয়েকজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি পালিয়ে যায়।
মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের সূত্র বলেছে, কেন্দ্রটিতে চিকিৎসা কর্মকর্তার নয়টি পদ থাকলেও আছেন আটজন। জ্যেষ্ঠ কনসালট্যান্টের একটি ও কনিষ্ঠ কনসালট্যান্টের দুটি পদ শূন্য রয়েছে। জ্যেষ্ঠ স্টাফ নার্স তেরোটি পদ থাকলেও আছেন মাত্র নয়জন। নার্সিং সুপারভাইজারের দুটি পদ শূন্য রয়েছে। সেবা তত্ত্বাবধায়কের একটি ও কনিষ্ঠ সেবা তত্ত্বাবধায়কের একটি পদ শূন্য। আবাসিক সাইকিয়াট্রিস্টের চারটি পদ থাকলেও আছেন মাত্র একজন। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের একটি পদ থাকলেও এ পদে কেউ নেই।

৪০ শয্যার কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রটিকে ১০০ শয্যা এবং পুনর্বাসন কেন্দ্রকে ১৫০ শযায় উন্নীত করার জন্য ২০০৭ সালে অবকাঠামো তৈরি করা হয়। গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ১০০ শয্যার নিরাময় কেন্দ্রটির উদ্বোধন করেন। কিন্তু পুনর্বাসন কেন্দ্র ১০ বছরেও চালু হয়নি।

তেজগাঁওয়ে কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের পরিচালক ও প্রধান কনসালট্যান্ট সৈয়দ ইমামুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জনবলের অভাবে নিরাময় কেন্দ্রের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

ঢাকার বাইরের তিন কেন্দ্র
ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় একটি করে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র আছে। তিনটি কেন্দ্রের মধ্যে সব চেয়ে খারাপ অবস্থা রাজশাহীর। রাজশাহীর উপশহর এলাকার ২ নম্বর সেক্টরের ২৪ নম্বর বাড়ির নিচতলা ভাড়া নিয়ে ১৯৯৯ সাল থেকে পাঁচ শয্যার আঞ্চলিক মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রটি করা হয়। দেখা গেছে, সেখানে অন্তর্বিভাগে কোনো রোগী চিকিৎসাধীন নেই। পাঁচটি শয্যা খাঁ খাঁ করছে। জানা গেল, ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কোনো রোগী চিকিৎসাধীন ছিল না।
কেন্দ্রের চিকিৎসক শেখ রবিউল আখতার প্রথম আলোকে বলেন, লোকবলের অভাবে জরুরি বিভাগ বন্ধ রাখা হয়েছে।

চট্টগ্রামের পাঁচলাইশের একটি দোতলার বাড়ির নিচতলায় আঞ্চলিক মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। ঘরটি স্যাঁতসেঁতে। এখানে পাঁচটি শয্যা পাতা আছে। জানা গেল, বৃষ্টি হলে কেন্দ্রটিতে পানি ঢুকে পড়ে। এ কারণে কোনো মাদকাসক্ত রোগী থাকতে চান না। কেন্দ্রটিতে একজন চিকিৎসা কর্মকর্তা, তিনজন নার্স ও একজন নিরাপত্তাকর্মী আছেন। তবে রাঁধুনি পদে কেউ নেই।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (চিকিৎসা ও পুনর্বাসন) মো. মফিদুল ইসলাম বলেন, দেশের সাতটি বিভাগে একটি করে ১০০ শয্যার মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র চালু করার পরিকল্পনা আছে সরকারের। জেলা পর্যায়ের হাসপাতালসহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য আলাদা বিভাগ চালু করা হবে। তখন মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা যথাযথ চিকিৎসা পাবেন।

খুলনা নগরীর সোনাডাঙ্গা বাইপাস সড়কের পাশে গল্লামারীতে চৌধুরী ভিলার দোতলায় ভাড়াবাড়িতে করা হয়েছে পাঁচ শয্যার মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র। ১৮ ফেব্রুয়ারি দেখা যায়, অন্তর্বিভাগে দুজন রোগী চিকিৎসাধীন। বাকি তিনটি বিছানা ফাঁকা। জরুরি বিভাগ নেই। একজন চিকিৎসক ও দুজন অফিস সহকারী থাকলেও তাঁরা আসেন না। একজন চিকিৎসক আছেন, রোগী এলে তাঁকে ফোন দিয়ে আনতে হয়।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রির মহাসচিব অধ্যাপক মোহিত কামাল বলেন, মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা নেই, শক্ত ব্যবস্থাপনাও নেই। কিন্তু সরকারের সেদিকে নজর নেই। এখন নতুন করে আইন করা হচ্ছে, সেই আইনে অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অনুমতি ছাড়া মাদকাসক্ত রোগীদের চিকিৎসাও করা যাবে না। তিনি বলেন, এভাবে চললে মাদকাসক্তের সংখ্যা যে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে, সেটা খুব সহজেই বলা যায়।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী, আবুল কালাম আজাদ ও প্রতিনিধি, খুলনা, শেখ আল এহসান)