প্রাণী চিকিৎসায় মাইলফলক

গরুর বাছুরের মূত্রথলিতে টিউব সংযোজন করা হচ্ছে। চট্টগ্রামের ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে।  ছবি: জুয়েল শীল
গরুর বাছুরের মূত্রথলিতে টিউব সংযোজন করা হচ্ছে। চট্টগ্রামের ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে। ছবি: জুয়েল শীল

গরু ও ছাগলের মূত্রনালিতে পাথর জমলে মৃত্যু অবধারিত। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এই রোগের নাম ‘ইউরোলিথিয়াসিস’। এই রোগে আক্রান্ত প্রাণী তিন থেকে পাঁচ দিন বা তারও বেশি সময় প্রস্রাব করতে পারে না। প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করে। প্রস্রাব জমে থাকায় পেট ফুলে যায়। একপর্যায়ে মূত্রথলি ফেটে প্রাণীটির মৃত্যু হয়।

চিকিৎসায় দু-একটি ক্ষেত্রে কিছুদিনের জন্য এই রোগ নিরাময় হলেও পুনরায় মূত্রনালিতে পাথর জমে। এই রোগে আক্রান্ত গরুর বাছুর (পরিণত বয়সের গরুর সাধারণত এ রোগ হয় না) এবং ছাগলের (ছয় থেকে আট মাস বয়সী ছাগলের এই রোগ হয়) মৃত্যু ঘটে। আক্রান্ত প্রাণীর মৃত্যুর হার শতভাগ। দেশে বছরে ইউরোলিথিয়াসিস রোগে আক্রান্ত গবাদিপশুর সংখ্যা পাঁচ লাখের মতো।

প্রাণঘাতী এই রোগ প্রতিরোধে বিস্ময়কর সাফল্য পাওয়া গেছে বাংলাদেশেরই এক বিজ্ঞানীর উদ্ভাবিত নতুন এক কৌশলে। তিনি চট্টগ্রামের ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ও সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক বিবেকচন্দ্র সূত্রধর। ইউরোলিথিয়াসিস রোগে আক্রান্ত প্রাণীদের বাঁচাতে তিনি এমন এক শল্যচিকিৎসা উদ্ভাবন করেছেন, যার সাফল্য শতভাগ। গুরুতর অসুস্থ মানুষ বিকল্পপথে যেভাবে প্রস্রাব করে, সেই পদ্ধতি গবাদিপশুর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে তিনি এই সাফল্য পেয়েছেন।

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গৌতমবুদ্ধ দাশ বলেন, বিশ্বের নানা দেশে এই রোগ নিয়ে অল্প কিছু কাজ হলেও বাংলাদেশের এটিই প্রথম আবিষ্কার। প্রাণীদের মূত্রনালির পাথরের মতো জটিল রোগের চিকিৎসার একমাত্র ভরসা বিবেকচন্দ্র উদ্ভাবিত শল্যচিকিৎসা।

এই রোগটি গরু ও ছাগলের বেশি হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বিবেকচন্দ্র জানালেন, কুকুর-বিড়ালসহ অন্য প্রাণীর তুলনায় গরু ও ছাগলের মূত্রনালি আঁকাবাঁকা। বাঁক নেওয়া অংশগুলোতে পাথর জমতে পারে সহজে। এ ছাড়া গরু বা ছাগলের বিচরণক্ষেত্র ক্রমেই কমে যাওয়ায় ঘাস বা তৃণজাতীয় প্রাকৃতিক খাবার তারা পাচ্ছে না। এর পরিবর্তে গবাদিপশুকে প্রস্তুত করা যেসব খাদ্য দেওয়া হয়, মূত্রথলিতে পাথর জমার তা অন্যতম কারণ।

এই রোগ থেকে প্রতিকারের উপায় খুঁজছিলেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক। পড়াশোনা ও গবেষণার কাজে যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে সফরে গিয়ে ইউরোিলথিয়াসিস রোগ নিরাময়ের কোনো কার্যকর পদ্ধতি খুঁজে পাননি তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও এই চিকিৎসা না থাকার বিষয়টি তাঁকে হতাশ করে। এ রোগে আক্রান্ত গরু-ছাগলকে জবাই করে দেওয়ার সহজ পন্থা চলে আসছে উন্নত দেশগুলোতেও। ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে চিকিৎসার কথা কিছুদিন ধরে শোনা গেলেও সাফল্যের হার ৭০ শতাংশের বেশি নয়। 

তিন বছর আগে ধরা দিল সাফল্য

দীর্ঘ গবেষণার পর বিবেকচন্দ্রের মনে হলো এ ধরনের রোগের ক্ষেত্রে ফলিক্যাথেটার (টিউব) ব্যবহার করে বিকল্প প্রস্রাবের পথ তৈরি করে যদি মানুষের জীবন বাঁচানো যায়, তাহলে অন্য প্রাণীর ক্ষেত্রেও সেটা সম্ভব হবে না কেন? হাসপাতালগুলোতে মানবদেহে ব্যবহৃত হয় এমন টিউব সংগ্রহ করেন তিনি। ২০১৪ সালের শেষ দিকে একটি ছাগলের মূত্রথলিতে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে টিউব লাগিয়ে প্রস্রাবের বিকল্প পথ তৈরি করে প্রথমবারেই সফলতা পান তিনি। এরপরের ঘটনা এ দেশের প্রাণী চিকিৎসার ইতিহাসে নতুন মাইলফলক সৃষ্টি করল। ২০১৫ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ৪৭টি গরু-ছাগলকে এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করেন বিবেক। তাঁর সাফল্য শতভাগ। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে সব কটি প্রাণীই সুস্থ আছে। এখন প্রায় প্রতিদিনই এ রোগে আক্রান্ত গবাদিপশুর চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা।

একদিক থেকে বলতে গেলে চিকিৎসাপদ্ধতিটি খুবই সহজ। আক্রান্ত গরু বা ছাগলের মূত্রথলিতে টিউব লাগিয়ে বিকল্প প্রস্রাবের পথ তৈরি করা হয়। দু-তিন সপ্তাহ বিকল্প প্রস্রাব করার পর শারীরবৃত্তীয় নিয়মে প্রাণীটির আগের প্রস্রাব পথের ত্রুটি সেরে যায় এবং প্রাণীটি তখন আবার স্বাভাবিক নিয়মে প্রস্রাব করতে পারে। তখন আবার অস্ত্রোপচার করে ওই টিউবটি অপসারণ করতে হয়। সব মিলিয়ে দুবারের শল্যচিকিৎসায় খরচ পড়ে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা।

গরু ও ছাগলের শরীরের এই অস্ত্রোপচারকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বলা হচ্ছে ‘সিস্টোটমি’। এটি কেবল চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়েই করা হচ্ছে। সারা দেশে এই পদ্ধতি এখনো চালু না হওয়ার কারণ হিসেবে দেশে বিশেষায়িত হাসপাতালের অভাবের কথা উল্লেখ করলেন শিক্ষক বিবেকচন্দ্র।

ইউরোলিথিয়াসিস রোগের বিষয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দেশে গবাদিপশুর সংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি। একটি উপজেলা পশু চিকিৎসাকেন্দ্রে বছরে গড়ে এই রোগে আক্রান্ত প্রায় ১ হাজার ২৫০টি গরু ও ছাগল চিকিৎসার জন্য আনা হয়। সেই হিসাবে সারা দেশের ৪৬০টি পশু চিকিৎসাকেন্দ্রে বছরে ৫ লাখের বেশি গবাদিপশু এই রোগে আক্রান্ত হয় বা মারা যায় বলে তাঁরা ধরে নেন। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবিত পদ্ধতি এই রোগ থেকে গবাদিপশুকে বাঁচানোর পথ দেখিয়েছে।

২০১৬ সালে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বৈজ্ঞানিক কর্মশালায় ১০টি ভেটেরিনারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-গবেষকদের সামনে এই চিকিৎসাপদ্ধতি উপস্থাপন করেন বিবেকচন্দ্র। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক ও ভারতের ভেটেরিনারি চিকিৎসকেরা উপস্থিত ছিলেন। ওই বছরই নিজের উদ্ভাবন নিয়ে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মতবিনিময় সভা করেন এই শিক্ষক। এ ছাড়া সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-চিকিৎসকদের সঙ্গে তিনি মতবিনিময় করেছেন। তাঁর গবেষণা ও চিকিৎসার অভিজ্ঞতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জার্নাল অব অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজিতে একটি নিবন্ধ প্রকাশ হতে যাচ্ছে।

এই শল্যচিকিৎসাপদ্ধতি সারা দেশে চালু করতে চান পশু চিকিৎসাবিষয়ক দেশের প্রাচীন ও শীর্ষস্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান ঢাকার বাংলাদেশ সেন্ট্রাল ভেটেরিনারি হাসপাতালের প্রধান কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেন। তিনি বলেন, এই পদ্ধতি চালু করার জন্য উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসকদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে তাঁরা কাজ করছেন।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ভেটেরিনারি ফ্যাকাল্টির সার্জারি ও অবস্টেটিকস বিভাগের প্রধান মিজানুর রহমান তাঁর প্রাক্তন ছাত্রের উদ্ভাবন সম্পর্কে বলেন, ‘বিবেকচন্দ্র নিবেদিতপ্রাণ একজন গবেষক ও শল্যচিকিৎসক। গরু ও ছাগলের রোগটি নিরাময়ের পন্থা উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন। এই চিকিৎসায় সাফল্যের হার বিস্ময়কর।’

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নীতিশ দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের কাজের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির ব্যাপার নেই। চিকিৎসাটি কাজে লাগছে। ফলে এখানে এটার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক জার্নালে নিবন্ধ ছাপা হলে বহির্বিশ্বের নজরে আসবে। তখন বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এই পদ্ধতি প্রয়োগ হবে।