হুদার নেতৃত্বে ৫৬ জনের সোনা চোরাচালান চক্র

>
- চক্রে চোরাকারবারি ৪৮, স্বর্ণ ব্যবসায়ী ৬, মানি এক্সচেঞ্জের ২ জন
- এই চক্রের সদস্যরা মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও দুবাই থেকে সোনা এনে ভারতে পাচার করেন
- এই প্রথম স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেটের প্রধান কোনো ব্যক্তি ধরা পড়লেন
৪৮ চোরাকারবারি, ছয় স্বর্ণ ব্যবসায়ী আর মানি এক্সচেঞ্জের দুই মালিক মিলে গড়ে উঠেছে ৫৬ জনের সোনা চোরাচালান সিন্ডিকেট। সঙ্গে রয়েছেন কলকাতার চার সোনা চোরাকারবারি। সিঙ্গাপুর, দুবাই ও মালয়েশিয়া থেকে তাঁরা মণকে মণ সোনা পাচার করেছেন ভারতে। এ দলের প্রধান এইচ এম শামসুল হুদাকে ৪ মার্চ বিমানবন্দর থেকে ইমিগ্রেশন পুলিশ আটক করে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি।
সিআইডির সংঘবদ্ধ অপরাধ দমন শাখার বিশেষ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর মতিয়ার রহমান ওরফে খলিল নামের যে শীর্ষ চোরাচালানি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পাসপোর্ট রেখে পালিয়ে যান, এইচ এম শামসুল হুদা সেই দলের প্রধান। মতিয়ারের পর তাঁরও বিদেশ ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ইমিগ্রেশন পুলিশ তাঁকে দেখামাত্র আটক করে।
পুলিশ জানায়, সোনা পাচারের বেশির ভাগ ঘটনায় শুধু এর বাহকেরা ধরা পড়েন। নেপথ্যে থেকে যাঁরা ব্যবসাটি নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁরা সব সময় আড়ালে থেকে গেছেন। এই প্রথম স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেটের প্রধান কোনো ব্যক্তি ধরা পড়লেন। শামসুল হুদা বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি ডলার পাচার করে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও দুবাই নিয়ে যান। সেখান থেকে সোনা কিনে তা বাংলাদেশ হয়ে ভারতে পাচার করেন। পুরো দলটি তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন।
সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মিনহাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অনেক দিন থেকেই তাঁরা শামসুল হুদার খোঁজ করছিলেন। কিন্তু তাঁকে শনাক্ত করতে পারছিলেন না। গত ২৩ আগস্ট তাঁরা হুদার খোঁজ পান। ওই দিন কাকরাইল মোড়ে এক লাখ ডলারসহ ধরা পড়েন শামসুল হুদার প্রধান সহযোগী মিঠুন আকন বিটন। গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে মিঠুন আকন জানান, এসব ডলার তিনি তাঁতীবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী শাহজাহানের কাছে দিতে যাচ্ছিলেন। তাঁদের স্বর্ণ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন শামসুল হুদা। তাঁর সঙ্গে টেলিফোনে তিন মাসে মিঠুন আকনের ৭৬ বার কথোপকথন হয়েছে বলে তদন্তে জানতে পারে সিআইডি। পরে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনি সিন্ডিকেটের ১৯ জনের নাম উল্লেখ করেন। পুলিশ অনুসন্ধানে জানতে পারে, শামসুল হুদা যে দলটি নিয়ন্ত্রণ করেন তাতে ৫৬ জন সদস্য রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চোরাকারবারি ৪৮, স্বর্ণ ব্যবসায়ী ছয়জন, আর মানি এক্সচেঞ্জের মালিক আছেন দুজন।
শামসুল হুদার সিন্ডিকেট
শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সোনার কারবারের জন্য দেশে ও বিদেশে হুদার সিন্ডিকেট রয়েছে। এর মধ্যে কলকাতা বড় বাজারের সোনাপট্টিতে রয়েছেন অজিত, রাম শর্মা, পারুল ও অখিল। তাঁদের সঙ্গে হুদার নিয়মিত যোগাযোগের প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। এর বাইরে সিঙ্গাপুর, দুবাই ও মালয়েশিয়ায় তাঁর যেসব লোকজন আছেন, তাঁদের ব্যাপারে খোঁজখবর করা হচ্ছে। ঢাকায় হুদার সিন্ডিকেটের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হলেন মতিয়ার রহমান ওরফে খলিল। গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পাসপোর্ট রেখে তিনি পালিয়ে যান। এরপর থেকে তাঁর কোনো খোঁজ নেই। অন্য সহযোগীদের মধ্যে তাঁতীবাজারের অলিয়র রহমান, নোয়াখালীর আবদুল বাতেন, ঢাকার জুরাইনের সুরুজ মিয়াসহ তারেকুজ্জামান, মানিক মিয়া, টিটু সুলতান, ইদ্রিস আলী, শাহজাহান মিয়া, কবির আহমেদ, মনির হোসেন, রাসেল আকন, রুহুল আমিন, জমির হোসেন, নিজাম ও লাকি আকন অন্যতম। তাঁদের সবার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কাছে তথ্য চেয়েছে সিআইডি। পুলিশের তালিকায় মজিবর রহমান ওরফে বাইন্যা মজিবরের নামও রয়েছে।
জানতে চাইলে মজিবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সিঙ্গাপুরে থাকার সুবাদে তিনি ঢাকার অনেক ব্যবসায়ীকে চেনেন। সেভাবে হুদাসহ অন্যদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছে। তিনি চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত নন বলে দাবি করেন।
মানি এক্সচেঞ্জের মধ্যে রাজধানী মানি এক্সচেঞ্জের মালিক শাহাদত বলেন, তিনি শামসুল হুদাকে চেনেন। সোনার কারবারের সঙ্গে তিনিও জড়িত নন বলে দাবি করেন।
কে এই শামসুল হুদা
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিদর্শক আশরাফুল ইসলাম জানান, শামসুল হুদার আদি নিবাস শরীয়তপুর সদরের কাকদি গ্রামে। তবে ১৯৭৩ সাল থেকে তিনি ঢাকায় আছেন। ১৯৭৮ সালে জীবন বীমা করপোরেশনের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি শুরু করেন।’ ৮১ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে সৌদি আরব চলে যান। ১৯৯০ সালে ফিরে এসে শরীয়তপুরে মুদি ও সার ডিলার হিসেবে ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৯৪ থেকে বিদেশ থেকে ঝাড়বাতি এনে বিক্রি করা শুরু করেন। ঘন ঘন বিদেশ যাতায়াতে জনশক্তি রপ্তানির দিকে আগ্রহী হয়ে ওঠেন হুদা। মেঘনা ওভারসিজ নামের এক প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হয়ে জনশক্তির ব্যবসা করেন। অবশ্য এক বছর আগে সেই ব্যবসাও তিনি বন্ধ করে দেন। পুলিশ জানায়, এসব ব্যবসা করতে গিয়ে সোনা চোরাচালান গ্রুপের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়ে যায়। ধীরে ধীরে সোনা চোরাচালানের দিকে ঝুঁকে পড়েন। একপর্যায়ে তিনি একটি দলের নিয়ন্ত্রক হয়ে যান।
শামসুল হুদার পরিবার থাকে মিরপুরের পল্লবী ডি ব্লকের একটি ছয়তলা বাড়িতে। গতকাল সেখানে গেলে আশপাশের লোকজন জানান, পল্লবী সি ব্লকে শামসুল হুদার আরও একটি ছয়তলা বাড়ি আছে। শামসুল হুদার স্ত্রী রুবিনা হুদা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের দুটি বাড়ির বিপরীতে ব্যাংক ঋণ আছে। তাঁর স্বামীর জনশক্তির ব্যবসা আছে। চোরাচালানিদের সঙ্গে হুদার যোগাযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে অন্য ব্যবসায়ীর সম্পর্ক থাকতেই পারে। তিনি আদমের কারবার করেন তো।’