যশোর পুলিশের নজর মানুষের জমিতে

যশোরে পুলিশ সুপারের বাসভবনের সীমানাপ্রাচীর উঠছে। এতে একজন শিক্ষিকার জমি ও তাঁর বাবা–মায়ের কবর বেদখল হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।  ছবি: এহসান-উদ-দৌলা
যশোরে পুলিশ সুপারের বাসভবনের সীমানাপ্রাচীর উঠছে। এতে একজন শিক্ষিকার জমি ও তাঁর বাবা–মায়ের কবর বেদখল হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ছবি: এহসান-উদ-দৌলা

পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে বিপদে পড়েছেন যশোর বি এ এস শাহীন কলেজের শিক্ষক কাজী লুৎফুন্নেসা। তাঁর জমি দখল করে যশোর পুলিশ সুপারের বাসভবনের সীমানাপ্রাচীর উঠছে। কিশোর ছেলেকে কোনো অভিযোগে ফাঁসানো হয় কি না, এই ভয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করতে ভয় পাচ্ছেন এই নারী শিক্ষক।

যশোর শহরে কমপক্ষে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় জমি দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। বিমানবন্দর সড়কে কাজী লুৎফুন্নেসার জমি ছাড়াও শহরের গাড়িখানা সড়কে ১০টি দোকান ও ৩১টি পরিবার উচ্ছেদ করে জমি দখল করেছে। আর জেলা পরিষদের জায়গায় দোকান বরাদ্দ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল যশোর পুলিশ।

শহরবাসীর অনেকে এবং ভুক্তভোগীরা বলছেন, যশোর পুলিশের এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করলে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হচ্ছে। যশোর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাধারণ মানুষ যেসব অভিযোগ করছে, তা মিথ্যা নয়।’

অভিযোগের তির মূলত পুলিশ সুপার আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে। ২০১৪ সালে তিনি এই জেলায় বদলি হয়ে আসেন। পুলিশ যা করছে তা পুলিশ সুপারের ইচ্ছাতেই হচ্ছে বলে মানুষের অভিযোগ। এসব অভিযোগের ব্যাপারে পুলিশ সুপারের বক্তব্য জানতে এক সপ্তাহ ধরে নানাভাবে চেষ্টা করা হয়। সর্বশেষ তিনি প্রথম আলোর কাছে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। 

বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হয় পুলিশের খুলনা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) দিদারুল আলমের সঙ্গেও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা আমার নলেজে নাই।’

পুলিশ সূত্র জানায়, সারা দেশে পুলিশ সুপারদের সবচেয়ে বড় বাংলোগুলোর একটি হচ্ছে যশোরে। এই বাংলোর পূর্ব পাশে ২৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ জমি কাজী লুৎফুন্নেসাদের। এই জমিতে তাঁর বাবা ও মায়ের কবর। লুৎফুন্নেসাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এখানেই। বর্তমানে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্বামী ও কলেজপড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে শহরের অন্য এলাকায় বসবাস করেন।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে গিয়ে দেখা যায়, পুলিশ সুপারের বাংলোর সীমানাপ্রাচীর তৈরির কাজ করছেন শ্রমিকেরা। বেশ কয়েকটি কংক্রিটের স্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে লুৎফুন্নেসার জমিতে। তাঁদের বাবা ও মায়ের কবর চলে গেছে এসপির বাংলোর সীমানার মধ্যে।

প্রতিবেশী এক মহিলা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপা (লুৎফুন্নেসা) এই শহরের সম্মানীয় ব্যক্তি। তিনি এই পাড়াতেই মানুষ হয়েছেন। শহরে তাঁর বহু ছাত্রছাত্রী। খুব খারাপ লাগে যখন দেখি, আপার আব্বা-আম্মার কবরও এসপি সাহেবের বাংলোর মধ্যে পড়ে যাচ্ছে।’

লুৎফুন্নেসা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসপি আমারই ছাত্র। আমি বহুবার তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি, অপেক্ষা করেছি। এসপি কথা বলেননি। অন্যদের মাধ্যমে চেষ্টা করেছি, লাভ হয়নি। পরে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছি।’

যশোর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) রেজা ই রাব্বি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি জমি কেউ দখল করলে আমরা তাকে উচ্ছেদ করতে পারি। কিন্তু এটা ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। আমরা অভিযোগটি পুলিশকে জানিয়েছি।’

পুলিশ সুপারের বাংলো থেকে কিছু দূরে পুলিশ লাইন। পুলিশ লাইনের সামনের জায়গাটি জেলা পরিষদের। পুলিশ সুপারের নির্দেশে ওই জায়গায় মাস ছয়েক আগে দোকান তৈরি হতে থাকে। ছোট ছোট প্লটে ইটের ঘর তৈরি হতে থাকে। অভিযোগ আছে, দোকান বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলে অনেকের কাছ থেকে টাকাও নেওয়া হয়।

জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জায়গাটি আমাদের, জেলা পরিষদের। আমাদের সঙ্গে কোনো কথা না বলে পুলিশ দোকান তৈরি করা শুরু করে। আমরা লিখিত অভিযোগ করার পর কাজ বন্ধ হয়।’ তবে পুলিশ লাইনের সামনে এখনো নতুন ইটের দেয়াল তৈরির নমুনা চোখে পড়ে।

শহরের কেন্দ্রে গাড়িখানা সড়কে বড় হরফের দেয়াললিখনে চোখ আটকে যায়। দেয়ালে লেখা, ‘পুলিশ এই সম্পত্তির মালিক।’ জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও জেলা প্রশাসকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জায়গাটির মালিক সরকার। সরকারের কাছ থেকে (মূলত জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে) লিজ নিয়ে এখানে প্রায় এক শ ব্যক্তি পরিবার নিয়ে বসবাস বা ব্যবসা করে আসছে। কারও পরিবার ১৯১০ সাল থেকে লিজ নিয়ে আসছে।

বর্তমান পুলিশ সুপারের নির্দেশে ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ১০টি দোকান ও ৩১টি আবাসিক ঘর থেকে মালিকদের হঠাৎই উচ্ছেদ করে পুলিশ। পুলিশ দাবি করে, এই জমির মালিক পুলিশ। এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে তদন্ত হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মালিকানা-সংক্রান্ত পুলিশ বিভাগের দাবি মোটেও সঠিক নয়। জেলা প্রশাসকের দপ্তর হতে পুলিশ বিভাগের নামে কোনো ইজারা বা বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। তাতে আরও বলা হয়, ওই জমিতে পুলিশ কোনো স্থাপনা নির্মাণ করে থাকলে সাইনবোর্ডসহ যেন তা অপসারণ করা হয়।

অন্যদিকে উচ্ছেদের ঘটনা তদন্ত করেছিল জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী পরিবারগুলোকে যেভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে, তা সুস্পষ্ট মানবাধিকারের লঙ্ঘন। যার দায়িত্ব যশোর জেলা পুলিশ কোনোভাবে এড়াতে পারে না।’

কিন্তু যশোর জেলা পুলিশ তার অবস্থান থেকে সরেনি। বরং যারা প্রতিবাদ করেছে, তারা মামলার শিকার হয়েছে। স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন রাইটসের পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিকেরও দোকান ছিল সেখানে। বিনয় উচ্ছেদের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংবাদ সম্মেলনের ছয় ঘণ্টার মধ্যে আমার নিরীহ ছেলের বিরুদ্ধে মামলা হয়।’ এরপর তাঁর ছেলে গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে বিনয় আবার সংবাদ সম্মেলন করেন। এরপর বিনয়ের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এসব মামলা এখনো চলছে। এসব ঘটনা নিয়ে প্রথম আলোসহ জাতীয় ও স্থানীয় সংবাদপত্রে একাধিক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল।

কাজী লুৎফুন্নেসা বহু বছর যশোর শহরে শিক্ষকতা করছেন। মাঝেমধ্যেই খবর পান, মিথ্যা অভিযোগে পুলিশ নিরীহ মানুষকেও গ্রেপ্তার করছে। তিনি বাবা-মায়ের কবরসহ জমি বেদখল হওয়া মেনে নিতে পারছেন না। আবার ছেলের কথা ভেবে পুলিশের বিরুদ্ধে বেশি দূর যেতেও পারছেন না।