'মালিক' হওয়ার স্বপ্নে নৃশংস দুই তরুণ

সন্দেহভাজন খুনি জহির ও মুরাদ
সন্দেহভাজন খুনি জহির ও মুরাদ

চামড়া কারখানাটি বন্ধ হলে চাকরি হারায় জহিরুল ইসলাম (২২) ও মুরাদ হোসেন (২০)। এরপর থেকেই নিজেরা কারখানা দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু টাকা জোগাড় হবে কীভাবে? শ্রমিক থেকে রাতারাতি মালিক হওয়ার স্বপ্ন নৃশংস করে তোলে এই দুই তরুণকে।

টাকা জোগাড় করার জন্য জহিরুল পূর্বপরিচিত একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী মাসুদ রানার একমাত্র ছেলে মাহমুদুর রহমান ফয়সালকে প্রথমে অপহরণ ও পরে হত্যা করেন। চলতি মাসের ৫ মার্চ অপহরণ ও হত্যার পর ২০ মার্চ ফয়সালের লাশ উদ্ধার ও সন্দেহভাজন এই খুনিদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

টাকা পেতে জহিরুল ও মুরাদের পরিকল্পনাটাও ছিল একটু অন্য রকম। যেহেতু ফয়সালের পরিবার জহিরুলের পূর্বপরিচিত তাই অপহরণ করে টাকার বিনিময়ে তাঁকে ‘মুক্তি’ দেওয়া সম্ভব ছিল না। এ কারণে তাঁদের পরিকল্পনা ছিল ফয়সাল প্রথমে খুন করবেন। এরপর ফয়সালের বাবার কাছে ফোন করে অর্থ হাতিয়ে নেবেন। জহিরুল ভেবেছিলেন, তাঁকে কেউ সন্দেহ করবে না।

পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে, খুনের আগে জহির আর মুরাদ হাজারীবাগের একটি মেস থেকে একটি মুঠোফোন চুরি করেন। সেই ফোন খুনের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের কাজে ব্যবহার করেন। ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার জন্য অন্যের মোবাইল ফোন চুরি করা। কেবল তা-ই নয়, খুনের আগেই একটি গর্ত খোঁড়া হয় ‘মরদেহ’ মাটিচাপা দেওয়া জন্য।

ফয়সাল সাভার স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণিতে পড়ত। বাবা-মায়ের সঙ্গে সাভারের হেমায়েতপুরের জয়নাবাড়ি এলাকার নিজ বাসায় থাকত। ৫ মার্চ সন্ধ্যার পর সে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু রাত ১০টার দিকে বাসায় না ফেরায় তার পরিবার ফয়সালকে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি শুরু করে। ফয়সালের চাচা আমির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ৫ মার্চের পর কত জায়গায় যে ফয়সালকে খুঁজেছি তার ইয়ত্তা নেই।

মাহমুদুর রহমান ফয়সাল
মাহমুদুর রহমান ফয়সাল

তবে অপহরণ হওয়ার ১৫ দিনের মাথায় ধরা পড়ে ফয়সাল অপহরণ আর খুনের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নকারী দুই আসামি জহির ও মুরাদ। গতকাল বুধবার ফয়সালকে হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। কেন ফয়সালকে অপহরণ করা হয়, কীভাবে খুন করা হয়, তা-ও জানিয়েছে জহির ও মুরাদ।

ফয়সাল অপহরণে পরিকল্পনা 
সাভারে ফয়সালদের বাসার খুব কাছে জহিরুল ইসলামদের ভাড়া বাসা। ফয়সালের বাবা মাসুদ রানার সাভারে হার্ড ওয়ারসহ নানা ব্যবসা আছে। ফয়সাল তাঁর একমাত্র ছেলে। ফয়সাল আর জহির সাভারের একই কলেজে পড়ত। প্রতিবেশী হওয়ার সুবাদে দুজন দুজনকে ভালোভাবে চিনতেন।

জহিরের বাবা এলাকায় হকারি করেন। লেখাপড়া শেষ না করেই তিনি হাজারীবাগের একটি চামড়া কারখানায় চাকরি নেন। সেখানেই মুরাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। একই মেসে থেকে তাঁরা চাকরি শুরু করেন। দুজনের মধ্যে ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। কিন্তু কয়েক মাস আগে তাঁদের কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। চাকরি হারানোর পর দুজনে মিলে কারখানা দেওয়ার চিন্তাভাবনা করেন। টাকা জোগাড় করার জন্য জহির তাঁর বন্ধু মুরাদকে বলেন, সাভারে তাঁর পরিচিত এক ছেলে আছে, যার বাবার অনেক টাকা। তাকে অপহরণ করে অনেক টাকা মুক্তিপণ আদায় করা যাবে।

মোবাইল চুরি

জহির আর মুরাদ হাজারীবাগের যে মেসে থাকতেন, সেই মেসের একজনের মোবাইল ফোন চুরি করেন। এরপর কেটে যায় দেড় মাস। এর মধ্যে দুজনই সাভারের নিরিবিলি জায়গা খুঁজে বের করেন। এরপর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী কোদাল কেনেন। সেই কোদাল দিয়ে দুজনে মিলে সাভারে কান্দাপাড়া হোসেন হাজীর বালুর মাঠের এক জায়গায় গর্ত করেন।

তদন্ত কর্মকর্তা সাভার থানার উপপরিদর্শক আজগর আলী প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন চুরি করা মোবাইল ফোন দিয়ে জহির ফয়সালকে মোবাইল ফোনে ডেকে আনে ওই বালুর মাঠে। ফয়সালকে বলা হয়, তাঁরা সেখানে বিয়ার খাবেন। ফোন পেয়ে ফয়সাল বালুর মাঠে আসার পর তিনজনে হাঁটতে থাকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ফয়সালকে গর্তের কাছাকাছি আনার পর ধাক্কা দিয়ে সেখানে ফেলা হয়। গলায় রশি দিয়ে শ্বাসরোধে খুন করেন। এরপর ফয়সালকে মাটিচাপা দিয়ে সেখান থেকে তাঁরা চলে যান।

পুলিশ কর্মকর্তা আজগর আরও বলেন, জহির আর মুরাদের পরিকল্পনা ছিল, ফয়সালকে খুন করার এক থেকে দুই দিন পর তার বাবার কাছে মুক্তিপণ চাইবেন। কিন্তু নিখোঁজের এক দিন পর ফয়সালের বাবা মোবাইল ফোনে জহিরের কাছে জানতে চান, ফয়সালের খোঁজ সে জানে কি না। এই ফোন পেয়ে ভয় পেয়ে যান জহির। তিনি মনে করছিলেন তাঁকে ফয়সালের পরিবার সন্দেহ করছে। তখন মুরাদকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা চলে যান দিনাজপুর। আর এতেই সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায় তাঁদের।

জহির-মুরাদের ধরা পড়া

ফয়সালের খোঁজ না মেলার পর তার পরিবার সাভার থানায় যোগাযোগ করে। শুরু হয় ফয়সালের সন্ধানে পুলিশের তৎপরতা। ফয়সাল দুটি নম্বর ব্যবহার করত। তার মুঠোফোনের সূত্র ধরে পুলিশ খোঁজ করতে থাকে। ফয়সালের মুঠোফোনের সূত্র ধরেই একটি নম্বর সন্দেহ করে পুলিশ। সেই নম্বরটির মালিককে খুঁজে বের করার পর পুলিশ জহির আর মুরাদকে খুঁজতে থাকে। হাজারীবাগে আসার পর তাঁদের মেসে এসে জানতে পারে, ৬ মার্চের পর জহির আর মুরাদ মেসে থাকে না। তখন পুলিশ নিশ্চিত হয়, এই দুজনকে ধরতে পারলে ফয়সালের খোঁজ পাওয়া যাবে।

ফয়সালকে খুন করার আগে থেকে দুজন তাঁদের মোবাইল ব্যবহার বন্ধ রাখেন। তবে জহির সাভারে তাঁর পরিচিত একজনের কাছে টাকা চেয়ে মোবাইল করেন। সেই সূত্র ধরে পুলিশ জানতে পারে, জহিরের অবস্থান দিনাজপুরের বিরামপুরে। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে বিরামপুরের একটি স্কুলের বারান্দা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করে।

ঘটনার ১৫ দিন পর গতকাল বুধবার সাভার থানায় অপহরণ ও খুনের মামলা করেন ফয়সালের চাচা আমির হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘টাকার জন্য জহির আমার ভাইপোকে খুন করেছে। আমরা জহির ও মুরাদের ফাঁসি চাই।’