ময়নাতদন্তের ভুলে হত্যা হয়ে যায় আত্মহত্যা

কোনো কোনো লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে স্পষ্ট আঘাতের কথা উল্লেখ ছিল। কোথাও ঘটনার পারিপার্শ্বিকতার মধ্যেই ছিল খুনের স্পষ্ট ইঙ্গিত। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তারা এসব কিছুই আমলে নেননি। শুধু ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। অথচ পরে জানা যায়, লাশের ময়নাতদন্তই ভুল ছিল। আগে যে ঘটনাগুলোকে ‘আত্মহত্যা’ বলা হয়েছিল, আদতে তা ছিল খুন।

খুনের এ রকম ১০টি ঘটনার কথা উল্লেখ করে পুলিশ সদর দপ্তরে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা পিবিআই। প্রতিবেদনটি ধরে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খুনের মতো নৃশংস একটি অপরাধে পুলিশ কর্মকর্তারা কোনো তদন্তই করেননি। হত্যার এই ঘটনাগুলোকে আত্মহত্যা বলে পুলিশের প্রতিবেদন দেওয়ার পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থের লেনদেন, তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতি ও পক্ষপাতিত্ব ছিল। 

তদন্ত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হত্যার স্পষ্ট আলামত থাকা সত্ত্বেও ‘আত্মহত্যা’ বলে চালিয়ে দেওয়াটা তদন্তপ্রক্রিয়ারই ব্যর্থতা। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা দুটি উদাহরণ শুনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে তদন্তকারী কর্মকর্তা ও চিকিৎসক প্রভাবিত হয়েছিলেন। এখানে লেনদেনের ঘটনাও ঘটতে পারে। এটা পুরো ব্যবস্থার (সিস্টেম) গলদ। পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’

ছিল খুনের ইঙ্গিত, তদন্তে আত্মহত্যা
রাজধানীর চকবাজারের একটি বাসা থেকে ২০১০ সালের ২৩ জুন আনিসুর রহমান নামের এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে চিকিৎসক মতামত দেন, আনিস আত্মহত্যা করেছেন। একাধারে থানা-পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ তদন্ত শেষে একই মতামত দেয়।

কিন্তু মামলার বাদী আনিসের ভাই জাহাঙ্গীর মিয়া তৃতীয়বারের মতো নারাজি দিলে আদালত পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন। পাঁচ বছর পর তদন্তে বেরিয়ে আসে প্রেমের সম্পর্কের জেরে আনিসুর রহমান খুন হয়েছিলেন। এ ঘটনায় অভিযুক্ত দুই আসামি গ্রেপ্তারের পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন।

পিবিআই ঢাকা মেট্রোর পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, আনিসের মাথার পেছনের অংশে কাটা দাগ ও রক্তক্ষরণ, বাঁ ঊরুতে তিন থেকে চারটি কাটা চিহ্ন, বুকের বাঁ পাশে খামচির দাগ ছিল। সুরতহাল প্রতিবেদনেও এসব চিহ্নের কথা উল্লেখ ছিল। ঘটনাস্থলেই রক্তমাখা একটি বাটালি ফেলে রাখা ছিল। কিন্তু ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক বা তদন্ত কর্মকর্তারা এর কিছুই আমলে নেননি। চিকিৎসক সঠিকভাবে ময়নাতদন্ত না করেই আত্মহত্যা বলে মত দিয়েছিলেন।

গাজীপুরের শ্রীপুরে সুমাইয়া আক্তার ফারহানা নামের এক গৃহকর্মীর মরদেহের সুরতহালে শরীরে বিভিন্ন আঘাতের কথা উল্লেখ ছিল। অথচ ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে মতামত দেওয়া হয়, সুমাইয়া আত্মহত্যা করেছিলেন। থানা-পুলিশও সে অনুযায়ীই ঘটনাটি ‘আত্মহত্যা’ বলে আদালতে প্রতিবেদন দেয়।

রাসায়নিক ও ডিএনএ পরীক্ষার পরও ময়নাতদন্তে ভুল
২০১৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে শ্বশুরবাড়িতে তিন সন্তানের জননী নিলুফা আখতার বাখারাকে (২৫) শ্বাসরোধে হত্যা করেন তাঁর দেবর। নিলুফারের ময়নাতদন্ত এবং ভিসেরা ও হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের এক চিকিৎসক মতামত দেন, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। পুলিশ ও সিআইডিও তাদের তদন্তে আত্মহত্যার কথা উল্লেখ করে। পরে পিবিআইর তদন্তে আসে ধর্ষণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে নিলুফারের দেবর তাঁকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন।

গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মিজানুর রহমানকে। আর তাঁর বান্ধবী সুমাইয়া নাসরিনকে হত্যা করা হয়েছিল ধর্ষণের পর বালিশচাপা দিয়ে। অথচ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, মিজান আত্মহত্যা করেছেন। আর সুমাইয়াকে যে ধর্ষণ করা হয়েছিল, সে বিষয়টিও উঠে আসেনি ডিএনএ টেস্টে।

ময়নাতদন্ত-প্রক্রিয়ার পরিবর্তন চায় পিবিআই
পিবিআই বলছে, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকেরা ডোমদের ওপর ‘অতিমাত্রায়’ নির্ভরশীল। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রভাবকের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রতিবেদন দেওয়া, সাক্ষী হওয়ার ভয়ে জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের ময়নাতদন্তের কাজে অংশ না নেওয়া, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক না থাকাও ময়নাতদন্ত ভুল হওয়ার কারণ বলে মনে করে সংস্থাটি।

পিবিআইর অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মাইনুল ইসলাম বলেন, ময়নাতদন্তের প্রক্রিয়ায় ভালো যন্ত্রপাতি যুক্ত করতে হবে। এ কাজে যুক্ত চিকিৎসকদের জন্য যথাযথ আর্থিক বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা থাকা উচিত। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান ও মেডিকোলিগ্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি সেলিম রেজাও রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী মহলের চাপে চিকিৎসকেরা প্রভাবিত হন বলে মনে করেন।

ময়নাতদন্ত করে কেউ আত্মহত্যা করেছে, না হত্যা করা হয়েছে, সে বিষয়ে ফরেনসিক চিকিৎসকের মতামত দেওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন সিআইডির ডিআইজি ভানু লাল দাস। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসক শুধু মৃত্যুর কারণ বলবেন। এটি হত্যা না আত্মহত্যা, সেটা বের করার দায়িত্ব পুলিশের।’