এক ভুক্তভোগীর অসহায় কান্না

টাকা দেওয়ার এক বছর পরও বিদ্যুতের সংযোগ পাননি মনছুর আলম। উল্টো কর্মকর্তাদের হয়রানির শিকার হয়ে জেলে যেতে হয়েছে তাঁর বাবাকে। গতকাল চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে দুদকের গণশুনানিতে হয়রানির কথা বলতে গিয়ে কান্না চেপে রাখতে পারেননি তিনি।  ছবি: প্রথম আলো
টাকা দেওয়ার এক বছর পরও বিদ্যুতের সংযোগ পাননি মনছুর আলম। উল্টো কর্মকর্তাদের হয়রানির শিকার হয়ে জেলে যেতে হয়েছে তাঁর বাবাকে। গতকাল চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে দুদকের গণশুনানিতে হয়রানির কথা বলতে গিয়ে কান্না চেপে রাখতে পারেননি তিনি। ছবি: প্রথম আলো
>
  • বিদ্যুৎ নিয়ে গণশুনানি।
  • মিটারের জন্য টাকা জমা দেন ছৈয়দ আলম।
  • কিন্তু মিটার না দিয়ে অপমান করা হয়।
  • কর্মকর্তারা পাল্টা মামলাও করেন।
  • ছৈয়দ আলম এখন কারাগারে।

সরকারি সেবা পেতে ঘুষ দিতে হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। শিকার হতে হয় নানা ধরনের হয়রানির। প্রতিকার পাওয়া যায় না বললেই চলে। বরং প্রতিকার চাইতে গেলে উল্টো আরও বেশি হয়রানির শিকার হতে হয়। তখন আর যাওয়ার জায়গা থাকে না কোথাও। দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহেই তার এক করুণ চিত্র পাওয়া গেল বন্দর নগরী চট্টগ্রামে।

বড় দুর্নীতিবাজদের প্রতিরোধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ভূমিকা নিয়ে আছে অনেক প্রশ্ন। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে সেবা পাওয়া নিয়ে যে হয়রানি, তার প্রতিকার দুদক কতখানি করতে পারে তারও পরীক্ষা হয়ে গেল গতকাল। হয়রানির প্রতিকারের জন্য শেষ পর্যন্ত দুদক কর্মকর্তার পা ধরে কাঁদতে হলো এক ক্ষুদ্র সেবা গ্রহীতাকে। গতকাল বুধবার চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ-সেবার মান নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আয়োজিত গণশুনানিতে ঘটেছে এ ঘটনা।

গণশুনানিতে দুদক কমিশনার নাসিরউদ্দীন আহমেদের সামনে অভিযোগ জানাতে গিয়ে প্রথমে কাঁদলেন বিদ্যুৎ গ্রাহক মনছুর আলম। বক্তব্য শেষ করে সোজা মঞ্চে উঠে দুদক কমিশনারের পা ধরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন তিনি। এ সময় মঞ্চে থাকা অন্য অতিথিরা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। দুদক কমিশনার তাঁকে সান্ত্বনা দেন এবং উঠে দাঁড়াতে বলেন। পরে কয়েকজন কর্মকর্তা ছুটে গিয়ে তাঁকে দর্শক সারিতে নিয়ে আসেন। 

মনছুর আলমের বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়ায়। গণশুনানিতে তিনি অভিযোগ করেন, এক বছর আগে দুটি মিটার সংযোগের জন্য চকরিয়া বিদ্যুৎ কার্যালয়ের এক কর্মকর্তার নামে ব্যাংকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা জমা দেন তাঁর বাবা ছৈয়দ আলম।

কিন্তু এখন পর্যন্ত মিটার সংযোগ দেওয়া হয়নি। কেন সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না তা জানতে ৭ মার্চ তাঁর বাবা স্থানীয় বিদ্যুৎ কার্যালয়ে যান। তখন তাঁকে অপমান করেন তিন কর্মকর্তা। এ ঘটনায় তাঁর বাবা টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওই কর্মকর্তারা পাল্টা তাঁদের (তিনি ও তাঁর বাবা) বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ মামলায় তাঁর বাবা ছৈয়দ আলম (৬৫) এখন কারাগারে।

এ অভিযোগ শোনার পর দুদকের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক আক্তার হোসেনকে বিষয়টি অনুসন্ধান করার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে নির্দেশ দেন কমিশনার নাসিরউদ্দীন আহমেদ। পরে নাসিরউদ্দীন আহমেদ পিডিবির কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা গ্রাহকদের টেলিফোন ধরেন না, সমস্যা শোনেন না। এটা আর করা যাবে না। অতীতে ভুল করলে শুদ্ধ হয়ে যান। অনিয়ম করলে জেলে যেতে হবে, চাকরি হারাতে হবে। আর কোনো অনুকম্পা দেখানোর সুযোগ নেই।’

গণশুনানিতে চট্টগ্রামের হালিশহরের বাসিন্দা আবু বকর অভিযোগ করেন, মিটার না দেখেই অফিসে বসে বিল তৈরি করা হচ্ছিল। স্থানীয় মিটার রিডার মোহাম্মদ ওমরকে বিষয়টি জানাতে এ মাসে তিনবার স্থানীয় বিদ্যুৎ কার্যালয়ে যান তিনি। কিন্তু একবারও তাঁর দেখা পাননি। পরে ফোনে অভিযোগটি জানালে মিটার রিডার ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তাঁকে বলেন, ‘আপনি আপনার ভবনের চারতলা থেকে লাফ দেন, সমাধান হয়ে যাবে।’

বিচার চেয়ে দুদক কমিশনারের পা ধরেন আলম
বিচার চেয়ে দুদক কমিশনারের পা ধরেন আলম

এ অভিযোগ শোনার পর দুদক কমিশনার বলেন, একজন মিটার রিডার কীভাবে গ্রাহককে চারতলা থেকে লাফ দিতে বলেন? তিনি মিটার রিডার ওমরকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে বলেন। পরে পিডিবি চট্টগ্রামের প্রধান প্রকৌশলী প্রবীর কুমার সেন বলেন, ওই মিটার রিডারকে প্রত্যাহার করা হবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ‘সেবা পাওয়া তো তাঁর অধিকার। এটা তো দয়াভিক্ষা নয়। অধিকারহীনতা কোন পর্যায়ে পৌঁছালে এ রকম ঘটনা ঘটে?’ তিনি বলেন, ‘মানুষের মন থেকে সেবা পাওয়ার এই বোধটাই মুছে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এ অবস্থা খুবই খারাপ সংকেত দেয়।’

গতকাল সকাল ১০টায় চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে ৩৮ জন গ্রাহক তাঁদের অভিযোগ তুলে ধরেন। বেশির ভাগ অভিযোগই ছিল মিটারে ওঠা ইউনিট অনুযায়ী বিল না দিয়ে অতিরিক্ত বিল দেখানোর বিষয়ে। গণশুনানি সঞ্চালনা করেন দুদকের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক আক্তার হোসেন।

দুদক কমিশনার নাসিরউদ্দীন আহমেদ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ-সেবা প্রদান ও যেকোনো ধরনের ভোগান্তি লাঘবে সমস্যা শুনতে প্রতি সপ্তাহে পিডিবি চট্টগ্রামের আওতাধীন মহানগরের ১২টি নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তরে গণশুনানির আয়োজন করার নির্দেশ দেন।

পরে প্রবীর কুমার সেন জানান, এখন থেকে প্রতি শনিবার বেলা তিনটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ওই দপ্তরগুলোতে গণশুনানির আয়োজন করা হবে।