পথে ওত পেতে থাকা হিংস্রতা

‘রিকশা কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি, একটি মোটরসাইকেল দ্রুত আমার পাশ দিয়ে গেল। মোটরসাইকেলে সেই ছেলেটি বসা। যাওয়ার সময় ছেলেটি আমার হাঁটুতে স্পর্শ করে যায়। পর মুহূর্তেই আমি বুঝতে পারি, ওই ছেলেটি আমার হাঁটুতে ব্লেড দিয়ে পোঁচ দিয়ে গেছে।’ কয়েক দিন আগে এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়ার কথা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন এক নারী।

বাসে করে বাসায় ফিরছিলেন আরেক নারী। হঠাৎ খেয়াল করেন, পেছনের আসনের এক লোক বারবার তাঁর কাছাকাছি আসছেন। তিনি বিরক্তি নিয়ে কিছুটা সরে যান। বাসে নিয়মিত যাতায়াত করার কারণে এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার প্রায়ই হতে হয়। তবে সেদিনের ঘটনায় তিনি হতভম্ব হয়ে পড়েন। বাস থেকে নামার পর তিনি টের পান, ব্লেড দিয়ে তাঁর সালোয়ার–কামিজ কেটে দেওয়া হয়েছে। ওই অবস্থায় কোনো রকমে তিনি বাড়ি ফিরে আসেন।

এর আগে এক সাংবাদিক অফিস থেকে রাতে বাসায় ফেরার সময় পথে নিগ্রহের শিকার হন। এক যুবক যখন তাঁকে হয়রানি করছিলেন, তখন আশপাশে অনেক লোক দাঁড়িয়ে থাকলেও কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেননি। প্রতিবাদও করেননি। একপর্যায়ে অপমানে তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকেন।

এই তিনজনই তাঁদের এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। তাঁরা বলেছেন, চলার পথে এমন নিপীড়ন, নিগ্রহ থেকে অন্য নারীদের সতর্ক করতেই তাঁরা জনসমক্ষে তা তুলে ধরেছেন। পোস্টগুলোও ‘পাবলিক’ রেখেছেন যাতে সবাই তা জানতে পারে। ‘কমেন্ট ও শেয়ার’ অপশনও খোলা রেখেছেন। সংশ্লিষ্টদের মতে, নারীকে আক্রমণের ধরনগুলো হিংস্র হয়ে উঠেছে। ব্লেড দিয়ে পোশাক কেটে দেওয়া ও শরীরে ক্ষত সৃষ্টি করা, গায়ে জ্বলন্ত সিগারেট ফেলা, পানি ঢেলে দেওয়া, হাঁটার সময় শরীর স্পর্শ করার ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে হিংস্র ও বিকৃত আনন্দ প্রকাশের ঘটনা ঘটছে। আর ফেসবুকে এসব অভিজ্ঞতা জানানোর ফলও যে ইতিবাচক হচ্ছে তা নয়। অনেক নারী এরপর সাইবার বুলিংয়ের (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাভাবে হেনস্তা করা, আপত্তিকর ছবি ও পোস্ট কোনো নারীর পেজে পোস্ট করা) শিকার হচ্ছেন। গত ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের দিনটিকে উদ্‌যাপন করতে রাজধানী ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বড় সমাবেশের আয়োজন করে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ওই সমাবেশে যোগ দেওয়া তরুণদের হাতে জায়গায় জায়গায় ছাত্রীসহ কয়েক তরুণীকে নিগ্রহের ঘটনার কথা উঠে আসে ফেসবুকে। নিপীড়নের কথা জানিয়ে এরপর সাইবার বুলিংয়ের শিকার হন তাঁরা। যে কয়জন ওই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকেই ফেসবুক থেকে পোস্ট সরিয়ে নিতে বাধ্য হন।

নারীর ওপর আক্রমণের ধরন হিংস্র হয়ে উঠছে মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন প্রথম আলোকে বলেন, জনপরিসরে নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এর সংখ্যাগত ও মাত্রাগত পরিবর্তন হয়েছে। নারীকে আক্রমণের ধরন হিংস্র হয়ে উঠেছে। ব্লেড দিয়ে পোশাক কেটে দেওয়া বা গায়ে জ্বলন্ত সিগারেট ফেলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে তা প্রকাশ পাচ্ছে।

ড. গীতি আরা নাসরীন বলেন, জনপরিসরে নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে আগে সাধারণ ধারণা ছিল যে শুধু বিশেষ প্রকৃতির, বিকৃতির বা বিশেষ মতাদর্শের মানুষই নারীকে নির্যাতন করে। নারীকে নির্যাতন করা যদি সহজ হয়, তবে নির্যাতনের মাধ্যমে ক্ষমতা প্রকাশ বা বিকৃত আনন্দ লাভের সুযোগ অনেকেই নিতে পারে। এটা বন্ধ না করলে এই নির্যাতনের সংস্কৃতি গেড়ে বসবে। নারী নির্যাতন করে পার পাওয়া বন্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যাঁরা আছেন, এটি তাঁদের অবশ্যকর্তব্য। অপরাধীকে দ্রুত শনাক্ত করা, দ্রুত বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। নারী নির্যাতনকারীকে চিহ্নিত করে ঘৃণার পাত্র করে তুলতে হবে। নির্যাতনের শিকার নারীদের ওপর দোষ চাপিয়ে যৌন নিপীড়কের আচরণকে বৈধতা দেওয়া নিপীড়ক মনোবৃত্তিরই নামান্তর।

ফেসবুকের পাতায় নিপীড়ন–কথন
গত ১১ মার্চ ফেসবুকে এক নারী লিখেছেন, ‘আজ আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। গুলশানের কাছাকাছি বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় এক ছেলে এসে আমার সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন। জানতে চান, “আপু কই যাবেন?”, “কিসে পড়েন?” বিনীতভাবে প্রথম দুটি প্রশ্নের জবাব দেওয়ার পর ওই ছেলে ফালতু প্রশ্ন করা শুরু করেন। এক মিনিটের ব্যবধানে আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসে বলা শুরু করেন, “তোমাকে তো আশপাশে প্রায়ই দেখি”, “তুমি খুব কিউট”। এমন পরিস্থিতি এড়াতে সামনে যেই রিকশা পেয়েছি তাতেই উঠে পারি এবং হঠাৎ বুঝতে পারি কেউ একজন পেছন থেকে আমার ওড়না টানছে। তাকিয়ে দেখি আর কেউ নয়, সেই ছেলেই। আমি শুধু বলি, “এই সব বেয়াদবি ক্যান করতেছেন, ছাড়েন!” রিকশা কিছুদূর যাওয়ার পর একটি মোটরসাইকেলকে দ্রুত আমার পাশ দিয়ে চলে যেতে দেখি। মোটরসাইকেলে সেই ছেলেটি বসা। যাওয়ার সময় ছেলেটি আমার হাঁটুতে স্পর্শ করে যায়। পর মুহূর্তেই আমি বুঝতে পারি ওই ছেলেটি আমার হাঁটুতে ব্লেড দিয়ে পোঁচ দিয়ে গেছে। আমার কামিজের ও লেগিংসের অংশ এতে ছিঁড়ে যায়। ব্লেডের আঘাত চামড়া ভেদ করে যায়। বাসায় পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি ক্ষত কতটা গভীর। সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল ঘটনা দেখেও আশপাশের কেউ টুঁ শব্দটিও করল না। জীবনে এত অসহায় আর কখনো লাগেনি...।’

হাজারের ওপর শেয়ার হওয়া ওই পোস্টে সমবেদনা জানিয়ে এবং প্রায় একই রকম অভিজ্ঞতার শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন আরও কয়েক জন নারী। তাঁরা বলেছেন, ‘সব সময় শুনি, মেয়েদের চুপ থাকতে হয়। এই চুপ থেকে থেকেই আমরা এদের সাহস বাড়াচ্ছি।’ আরেকজন লিখেছেন ‘ঘরে বসা লাগবে। আল্লাহর ওয়াস্তে আর কোনো উপায় নেই।’ আরেক নারী লিখেছেন, ‘এক বছর আগে আমার সঙ্গেও এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল। আমাকেও এগুলোই বলেছে। আমার চিৎকারে লোকজন জড়ো হয়ে যায়। পরে আম্মু আমাকে নিয়ে চলে আসে সেখান থেকে।’ এ ধরনের ঘটনার মুখে পড়লে আত্মরক্ষার জন্য ধারালো কিছু সঙ্গে রাখা ও হামলাকারীকে পাল্টা আঘাতের পরামর্শ দিয়েছেন কেউ কেউ।

ফেসবুকে নারীদের একটি গ্রুপে পথে চলতে গিয়ে নিপীড়নের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন এক নারী। তিনি জানান, একটি বেসরকারি সংস্থার বাইক ভাড়া করে গন্তব্যে যাচ্ছিলেন। কারওয়ান বাজারে ট্রাফিক সিগন্যালে অপেক্ষায় থাকার সময় টের পান একটি হাত তাঁর পিঠ ছুঁয়ে চলে গেল। তিনি লেখেন, ‘আমি সঙ্গে সঙ্গে পেছনে ঘুরে দেখি লোকজন রাস্তা পার হচ্ছে। বুঝতে পারলাম রাস্তা পার হওয়ার সময় কেউ হাত দিয়ে আমার শরীর স্পর্শ করেছে। আমি সালোয়ার-কামিজ পরা ছিলাম। আর বাইকে ওড়না দিয়ে সব সময় ঢেকেঢুকে প্যাকেট করে রাখতে হয়। তাও কেন?...একটা অবাঞ্ছিত হাতের স্পর্শ যে কতটা ভয়ংকর। সেই মুহূর্তটায় মরে যেতে ইচ্ছা করে। এই অনুভূতি বলে বোঝানোর মতো নয়। যত দিন যাচ্ছে, আমরা মেয়েরা ততটাই শিখছি, জানছি। অন্ধকার পেরিয়ে আলোর পথে পা রাখছি। ঠিক সমান্তরালে আমাদের ছেলেরা অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে।’

তবে ফেসবুকে নিপীড়নের কথা জানিয়ে সমবেদনার পাশাপাশি প্রতিক্রিয়াশীলদের অকথ্য গালিগালাজ শুনতে হয়েছিল বলে জানান বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল সময়ের প্রতিবেদক বীথি সপ্তর্ষি। অফিস শেষে রাতে বাসায় ফেরার জন্য বাসের অপেক্ষায় তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। সেখানে শুরু থেকেই এক যুবক তাঁকে হয়রানি শুরু করে। একপর্যায়ে প্রতিবাদ করবেন সিদ্ধান্ত নিয়ে মুঠোফোনের ভিডিও অন করে ছেলেটির কাছে জানতে চান, কেন তাঁকে হয়রানি করা হচ্ছে। ফেসবুকে বীথির পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা যায়, ওই যুবকটির মধ্যে কোনো অনুশোচনা তো নেই-ই, উল্টো দাপট দেখানো শুরু করে। তাঁদের দুজনের কথা-কাটাকাটি আশপাশের অনেকে দাঁড়িয়ে দেখলেও কেউ কোনো প্রতিবাদ করেননি। একপর্যায়ে অপমানে বীথি রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে শুরু করেন।

পরে আরেক পোস্টে বীথি সপ্তর্ষি লেখেন, ‘...লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল বলে এক “পটেনশিয়াল রেপিস্ট”–এর সঙ্গে বচসার একপর্যায়ের তা ভিডিও করে রাখি এবং পরে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করি। সেই ভিডিও ভাইরাল হলে সহানুভূতি যেমন যেমন পাচ্ছিলাম, তার চেয়ে বেশি পাচ্ছিলাম আমার চারিত্রিক ব্যবচ্ছেদ। বলা হচ্ছিল, আমার পোশাক পরিচ্ছদ কেমন ছিল যে কারণে ছেলেরা তাকায়, আর পাচ্ছিলাম আমাকে আরও কারা কারা সামনে পেলে পীড়ন করতে ইচ্ছুক তার তালিকা। কমেন্টগুলো দেখে বারবার ভেবেছিলাম ভিডিওটা মুছে ফেলি। আমি যদি নোংরামির কাছে মাথা নত করি, ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস অনেকের হারিয়ে যাবে। দাঁতে দাঁত চেপে মানুষের বিষোদ্গার দেখেছি বাধ্য হয়ে।’

এ নিয়ে বীথি সপ্তর্ষি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবাদ করার পর একজন নারীকে যদি এভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়, তাহলে আর কেউ মুখ খুলতে সাহস পাবেন না। যে পুরুষেরা এ ধরনের হয়রানি করেন, তাঁদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা সেই জায়গায় আপনার মা-বোনকে একবার ভাবুন। নিজেদের মা-বোনকে যেভাবে নিরাপদ দেখতে চান, তেমনভাবে অন্যদেরও দেখুন।’