বিএনপির প্রার্থীরা দৌড়ের ওপর, আ.লীগের চারজন মাঠে

হাবিবুর রহমান মোল্লা, সালাহউদ্দিন আহমেদ, কাজী মনিরুল ইসলাম ও নবী উল্লাহ
হাবিবুর রহমান মোল্লা, সালাহউদ্দিন আহমেদ, কাজী মনিরুল ইসলাম ও নবী উল্লাহ
>

• ঢাকা-৫ জাতীয় সংসদের ১৭৮ নম্বর আসন।
• আ. লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী চারজন মাঠে।
• বিএনপির প্রার্থীদের প্রকাশ্যে তেমন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।
• বিএনপির একজন জেলে, দুজন আদালতের বারান্দায়।

একবার বিএনপি, একবার আওয়ামী লীগ। একবার নৌকা, আরেকবার ধানের শীষ। একবার সালাহউদ্দিন আহমেদ, আরেকবার হাবিবুর রহমান মোল্লা। কিছুটা ব্যতিক্রম বাদে এভাবে চলছে গত ২৭ বছর।

তবে এবার আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে মাঠে নেমে পড়েছেন অন্তত চারজন। তবে বিএনপির প্রার্থীদের প্রকাশ্যে তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। মামলা-মোকদ্দমায় হাজিরা দিতে অনেকের বেশি সময় কাটছে আদালতের বারান্দায়।

বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছে তীব্র অভ্যন্তরীণ কোন্দল। আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে সদ্ভাব নেই। আবার প্রকাশ্যে কোন্দলও নেই।

আসনটির নাম ঢাকা-৫। জাতীয় সংসদের ১৭৮ নম্বর আসন। যাত্রাবাড়ী, ডেমরা থানার ৪৮, ৪৯ ও ৫০ নম্বর ওয়ার্ড; ডেমরা, দনিয়া, মাতুয়াইল, সারুলিয়া ইউনিয়ন ও কদমতলী থানার কিছু অংশ নিয়ে আসনটি গঠিত। বর্তমানে এ আসনে ভোটারসংখ্যা ৪ লাখ ১৬ হাজার ২১ জন।

এলাকাটি যেন খানিকটা শহর, খানিকটা গ্রাম। ঘনবসতিপূর্ণ। কিন্ডারগার্টেন, প্রাইমারি, হাইস্কুল, মাদ্রাসা, কোচিং সেন্টারে ঠাসা। নিচু এলাকা বলে জলাবদ্ধ জীবন এখানকার মানুষের ভবিতব্য। পৌষ-মাঘ মাসেও ঘিঞ্জি সড়কে জমে থাকে নোংরা কুচকুচে পানি। অচেনা কারও কাছে মনে হতে পারে, অসময়ে বর্ষাকাল এল বুঝি! আর দূষণ ও মাদকের রমরমা কারবার নিয়ে উদ্বিগ্ন এখানকার সাধারণ মানুষ।

গত কয়েক দিন এলাকায় ঘুরে, নানা শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই দেখা গেল। তবে এলাকায় রাস্তাঘাট সম্প্রসারণ, পয়োনিষ্কাশনের নালা তৈরিসহ নানা উন্নয়নকাজ চলমান দেখা গেছে। অনেকের অভিযোগ, কাজের গতি ধীর। উন্নয়নকাজের জন্য রাস্তা বন্ধ থাকাসহ বিভিন্ন কারণে মানুষকে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে।

দনিয়া পাঠাগার ও সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি মো. শাহনেওয়াজ প্রথম আলোকে বললেন, এখানকার মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা চলাফেরা। যে উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে, আসন্ন বর্ষা মৌসুমের আগে তা শেষ করা না গেলে শোচনীয় অবস্থা হতে পারে। তিনি বলেন, এলাকায় বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই। তিনি খেলার মাঠ, মুক্তমঞ্চ, মিলনায়তন প্রতিষ্ঠাসহ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সচল করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

গত ২৯ মার্চ পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জের বাসায় হাবিবুর রহমান মোল্লার ছেলে ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান মোল্লার (সজল) সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি দাবি করেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করা যায়নি। তবে এখন এলাকায় ব্যাপক উন্নয়নকাজ হচ্ছে। কয়েক মাসের মধ্যেই তা দৃশ্যমান হবে। তিনি বলেন, ‘যাত্রাবাড়ী-মৃধাবাড়ী সড়কটি আমাদের গলার কাঁটা হয়ে আছে। এবার আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ জলাবদ্ধতা নিরসন। এরপর মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ-এই তিনের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই।’

একসময় যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, শ্যামপুর, কদমতলীসহ পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে ছিল ঢাকা-৪ আসন। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এলাকাটিকে ভাগ করে ঢাকা-৪ ও ঢাকা-৫ আসন ঘোষণা করা হয়।

সিটি করপোরেশনের এখানকার তিন কাউন্সিলরের মধ্যে একজন আওয়ামী লীগ, একজন বিএনপি ও একজন স্বতন্ত্র। অপর দিকে চার ইউপি চেয়ারম্যানের মধ্যে তিনজন বিএনপির (একজন এর মধ্যে মারা গেছেন) এবং একজন আওয়ামী লীগের।

আ. লীগের চারজন মাঠে
এই আসনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থিতার দৌড়ে এবারও এগিয়ে বর্তমান সাংসদ হাবিবুর রহমান মোল্লা। শ্রমিক লীগের রাজনীতি থেকে উঠে আসা হাবিবুর রহমান দীর্ঘদিন ধরেই জনপ্রতিনিধি। আশির দশকে মাতুয়াইল ইউপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৯৬,২০০৮ ও সর্বশেষ ২০১৪ সালে তিনি এই আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। এবারও তিনি মাঠে আছেন।

এর বাইরে দলীয় মনোনয়নের জন্য জোরেশোরে মাঠে আছেন যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী মনিরুল ইসলাম। নির্বাচনী এলাকায় তাঁকে সমর্থন করে বেশ পোস্টার দেখা গেছে। এর আগে ১১ বছর তিনি ডেমরা থানার সভাপতি ছিলেন। ১৯৭৭ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে তিনবার কাউন্সিলর ছিলেন।

কাজী মনিরুল ইসলামের সঙ্গে ৩০ মার্চ তাঁর মিরহাজিরবাগের বাসায় কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবারই তিনি মনোনয়ন চান। ২০০৮ সালে তাঁকে মনোনয়ন দেওয়ার চিন্তাভাবনা হয়েছিল। এবারও মনোনয়ন চাইবেন। তাঁর ভাষ্য, ‘মোল্লা সাহেব ও সালাহউদ্দিন সাহেবকে মানুষ দেখেছেন। তাঁরা চান একজন ভালো মানুষ আসুক।’

হাবিবুর রহমান মোল্লা বয়সের কারণে নির্বাচন করতে না পারলে তাঁর ছেলে মশিউর রহমান মোল্লা দলীয় মনোনয়ন চাইতে পারেন, এমন আলোচনাও স্থানীয়ভাবে আছে। মশিউর রহমান দাবি করেন, এলাকায় আওয়ামী লীগের অবস্থা বেশ শক্ত। নিজ দলের বাইরেও তাঁদের জনসমর্থন আছে।

অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে আছেন ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম। যাত্রাবাড়ী ও ডেমরা এলাকায় রফিকুল ইসলামকে সমর্থন করে পোস্টার দেখা গেছে। রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক দিন ধরেই রাজনীতিতে আছি। এবার দলের মনোনয়ন চাই।’

যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনর রশীদও মনোনয়ন চাইবেন বলে স্থানীয়ভাবে আলোচনা আছে।

বিএনপির একজন জেলে, দুজন আদালতের বারান্দায়
এই আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন কেন্দ্রীয় বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ সালাহউদ্দিন আহমেদ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহসভাপতি নবী উল্লাহ ও কেন্দ্রীয় গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক মো. সেলিম ভূঁইয়া।

সালাহউদ্দিন আহমেদ ১৯৯১,১৯৯৬ (১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন) এবং ২০০১ সালে এখান থেকে নির্বাচিত হন। ২০০৬ সালের ৫ মে শনির আখড়ায় পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসের দাবিতে আন্দোলনরত জনতার তোপের মুখে পড়ে তাঁর দৌড়ে পালিয়ে আসার ঘটনাটি আজও আলোচিত।

সাবেক কাউন্সিলর নবী উল্লাহ যাত্রাবাড়ী, ডেমরা এলাকায় দীর্ঘদিন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। যদিও সর্বশেষ কাউন্সিলে তিনি হেরে গেছেন। এই হারার পেছনে নবী উল্লাহর সমর্থকেরা অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে দায়ী করেন। আবার ২০০৮ সালে সালাহউদ্দিনের পরাজয়ের পেছনে তাঁর সমর্থকেরা নবী উল্লাহর বিরোধিতাকে অন্যতম কারণ মনে করেন।

বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী তিনজনের মধ্যে মিল হলো প্রত্যেকেই একাধিক মামলার আসামি। ১০৩টি মামলা মাথায় নিয়ে ঘুরছেন সালাহউদ্দিন। নবী উল্লাহর বিরুদ্ধে মামলা ৩৮ টি। ২১টি মামলা আছে সেলিম ভূঁইয়ার বিরুদ্ধেও। ফলে আদালতের বারান্দায় বেশি সময় কাটছে তাঁদের। নবী উল্লাহ এখন কারাগারে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী ও তাঁদের অনুসারীরা বলেছেন, তাঁরা মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন। আন্দোলন ও নির্বাচন-দুই প্রস্তুতিই তাঁদের আছে। সম্ভাব্য তিন প্রার্থীর পক্ষ থেকেই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়টি স্বীকার করা হয়েছে।

দলীয় মনোনয়নের ব্যাপারে কতটা আশাবাদী জানতে চাইলে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সব সময় এলাকার উন্নয়নের জন্য কাজ করেছি। কখনো নিজের জন্য কাজ করিনি। আশা করি, আবার কাজ করার সুযোগ পাব।’

প্রার্থিতা ও নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে ৩০ মার্চ সকালে দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী এলাকার ‘নবীনগরে’ নবী উল্লাহর বাড়িতে গেলে তাঁর স্ত্রী লুৎফুন্নাহার বলেন, ‘৩৮টি মামলা নিয়ে বসে আছি আমরা। এর মধ্যে দুই মাসের ব্যবধানে ৩২টি মামলা দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, মামলা লড়ার পাশাপাশি তাঁদের নির্বাচনের প্রস্তুতিও আছে।

অপর দিকে শিক্ষকনেতা সেলিম ভূঁইয়ার ভাষ্য, এবার তাঁর ব্যাপক প্রস্তুতি। তাঁর গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। তাঁর হিসাব, এই আসনে বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলের ভোটার ৫০ শতাংশ। আর নোয়াখালী অঞ্চল ধরলে তা ৮০ শতাংশের মতো। যা ভোটের রাজনীতিতে তাঁর পক্ষে বাড়তি পাওনা হবে।

শেষ কথা
ঢাকা-৫ আসনের ভোটাররা জনপ্রতিনিধিদের কাছে উন্নয়নমূলক কাজ আশা করেন। একসময় নিরাশ হন, আবার আশায় বুক বাঁধেন। তাই তাঁরা বারবার জনপ্রতিনিধি বদল করেন। যিনি এলাকার উন্নয়নের জন্য কাজ করেছেন বা করবেন, তাঁকেই বেছে নেবেন এখানকার ভোটাররা।