হিজরতের নামে সন্তানসহ বাড়ি ছাড়েন মিতু

দুই সঙ্গীসহ মিতুকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব-১১-এর একটি দল।
দুই সঙ্গীসহ মিতুকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব-১১-এর একটি দল।

ফেসবুকে ছয় মাস আগে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) এক সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ হয় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতুর (১৯)। এরপর ধীরে ধীরে উগ্রবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন তিনি। স্বামীকেও একই পথে আনার চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হয়ে শিশুকন্যাসহ ‘হিজরতের’ নামে বাড়ি ছাড়েন মিতু। পরে তাঁর বাবা ও স্বামীর কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে গত মঙ্গলবার দুই সঙ্গীসহ মিতুকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব-১১-এর একটি দল।

মিতু সোনারগাঁয়ের প্রতাপের চর এলাকার নুরুল ইসলামের মেয়ে এবং জুয়েল হোসেনের স্ত্রী। ২০১৭ সালে সোনারগাঁয়ের মেঘনা শিল্পনগরী স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করে একই প্রতিষ্ঠানে এইচএসসিতে ভর্তি হন মিতু।

জঙ্গিবাদে জড়িয়ে দুই বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে মিতু বাড়ি ছাড়েন গত ৩১ মার্চ। ২ এপ্রিল তাঁর বাবা ও স্বামী এ খবর র‍্যাবকে জানান। মিতুর বাবা ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মিতুর আচরণ সন্দেহজনক হওয়ায় তাঁকে ওই পথ (উগ্রবাদ) থেকে ফেরানোর জন্য চেষ্টা করেছি। পাশাপাশি আইনের সহায়তার জন্য বিষয়টি র্যাবকে জানিয়েছি।’

গতকাল বুধবার সিদ্ধিরগঞ্জে র‍্যাব-১১-এর কার্যালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুল হাসান বলেন, পরিবারের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর র্যাব নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালায়। পরে গোপন সূত্রে খবর পেয়ে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার সোনাকান্দায় অভিযান চালিয়ে দুই সহযোগীসহ মিতুকে আটক করে। এ সময় তাঁর শিশুসন্তানকেও উদ্ধার করে। আটক অপর দুজন হলেন চট্টগ্রামের রাউজানের মেহেদি হাসান (২২) ও নোয়াখালীর হাতিয়ার আকবর হোসেন (৩০)।

কামরুল হাসান জানান, জিজ্ঞাসাবাদে মিতু র্যাবকে বলেছেন, তিনি ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ‘আল্লাহর সৈনিক’ নামে একটি ফেসবুক আইডির সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর ফেসবুকে জেএমবির সদস্য মেহেদি হাসানের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। এরপর ধীরে ধীরে উগ্রবাদে আকৃষ্ট হয়ে জেএমবিতে যোগ দেন মিতু। তিনি নিজেও ‘এসো ইসলামের পথে’ ও ‘আলোর পথ ইসলাম’ নামে দুটি ফেসবুক আইডি খোলেন এবং বিভিন্ন যুদ্ধ, অস্ত্র ও গোলাবারুদের স্থিরচিত্র, ভিডিও চিত্রসহ উগ্রবাদী মতবাদ প্রচার করতে থাকেন। কাছের বন্ধুবান্ধবকেও উগ্র মতবাদে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। মিতু তাঁর স্বামীকেও উগ্রবাদের পথে আনার চেষ্টা করেন। এতে ব্যর্থ হয়ে মেহেদির পরামর্শে স্বামীকে ত্যাগ করে ‘শহীদি মৃত্যুবরণের’ লক্ষ্যে হিজরতের পরিকল্পনা করেন। মেহেদি তাঁকে বলেন, মাহরাম ছাড়া হিজরত করা যাবে না। মাহরাম হিসেবে বন্ধু আকবর হোসেনকে গ্রহণ করার প্রস্তাব দেন মেহেদি। এরপর আকবরের সঙ্গে মিতুর যোগাযোগ করিয়ে দেন মেহেদি। আকবরকে মাহরাম হিসেবে পেতে মিতু তাঁর স্বামীকে তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ৩১ মার্চ মিতু তাঁর সোনারগাঁয়ের বাসা থেকে চট্টগ্রামে মেহেদি ও আকবরের কাছে চলে যান।

জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতু।
জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতু।

র‍্যাব-১১-এর অধিনায়ক জানান, মিতু তাঁদের বলেছেন, চট্টগ্রামে মেহেদি ও আকবর তাঁকে একটি ভাড়া বাসায় রেখে ‘শহীদ’ হতে বিভিন্ন ধরনের কৌশল ও পরামর্শ দিতে থাকেন। এ সময় তাঁরা নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও ঢাকার জেএমবির কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে সংগঠনের কর্মী সংগ্রহের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। এ লক্ষ্যে তাঁরা নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার সোনাকান্দায় একত্র হয়েছিলেন।

র‍্যাব জানায়, আটক মেহেদির বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজানে। লেখাপড়া করেছেন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। তিনি ২০১১ সাল থেকে চট্টগ্রামের একটি খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানির বিক্রয় ব্যবস্থাপক হিসেবে চাকরি করছেন। তিনি ২০১৫ সালে জনৈক সামি ভাইয়ের মাধ্যমে হানাফি মাজহাব থেকে সালাফি মতাদর্শ গ্রহণ করেন। পরে জেএমবিতে যোগ দেন। তিনি ২০১৮ সালে কয়েকবার নারায়ণগঞ্জের বন্দর ও সোনারগাঁয়ে গিয়ে বিভিন্ন গোপন বৈঠক করেছেন। নারীদের মাঝে পর্দার আড়ালে থেকে তিনি জেএমবির আদর্শিক বয়ান করেছেন। এর সুবাদে সোনারগাঁয়ের বিভিন্ন জায়গায় মিতুর সঙ্গে মেহেদির একাধিকবার দেখা হয়।

আর আকবরের বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়ায়। র‍্যাব জানায়, আকবরের লেখাপড়াও পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। তিনি ২০০৭ সাল থেকে চট্টগ্রামের হালিশহরে একটি বেকারির বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করছেন। এই চাকরির সুবাদে ২০১৬ সালের শেষ দিকে মেহেদির সঙ্গে তাঁর পরিচয়। এরপর উগ্রবাদে জড়ান। ফেসবুকেও সক্রিয় তিনি। বিভিন্ন সময়ে সরকার ও পুলিশ সম্পর্কে বিভিন্ন উসকানিমূলক বক্তব্যও ফেসবুকে পোস্ট করেছেন তিনি। জিজ্ঞাসাবাদে আকবর বলেছেন, এ পর্যন্ত তিনি ১০-১২ জনকে জেএমবির মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

গত রাতে র‍্যাব-১১-এর জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার আলেপ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আটক তিনজনসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে বন্দর থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা করেছে র‍্যাব।

রাজশাহীতে সাতজন গ্রেপ্তার
গতকাল ভোরে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়িহাট থেকে ছয় নারীসহ সাতজনকে জঙ্গি সন্দেহে গ্রেপ্তার করেছে জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।

রাজশাহী ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমিত চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক ব্যক্তিরা জেএমবির সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তাঁদের মধ্যে দুজন পুলিশের তালিকাভুক্ত জেএমবির সদস্য। বাকিরা নতুন সদস্য। পরে সংবাদ সম্মেলন করে তাঁদের পরিচয়সহ বিস্তারিত জানানো হবে বলেও জানান সুমিত চৌধুরী।