আমি জানতে চাই

আমি নিজে একজন চিকিৎসক। ৮ এপ্রিল রাত তিনটায় প্রচণ্ড জ্বর, পেটব্যথা, সঙ্গে হার্নিয়ার ব্যথা আর মৃদু শ্বাসকষ্ট নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে যাই। চিকিৎসক সব শুনে বললেন কার্ডিওলজিতে ভর্তি হয়ে দেখিয়ে নিতে। কার্ডিয়াক কোনো সমস্যা না পেলে সার্জারিতে ট্রান্সফার করে নেবেন।

ভর্তি হলাম ৩২-এ। বেড নেই, মেঝেতেও জায়গা নেই। চাদর, কাঁথা আর বালিশ এনেছিলাম। ইসিজি বেডে শুয়ে থাকলাম। জ্বরে কাঁপতে দেখে ইন্টার্ন চিকিৎসক ও সিস্টাররা খুব সহযোগিতা করলেন।

ভোরে রোগী আসতে থাকলে তাঁরা বাধ্য হয়ে আমাকে অনুরোধ করেন বিছানা ছাড়ার। পিসিসিইউতে মাটিতেও জায়গা নেই। ছোট একটু জায়গায়, যেটা চলাচলের রাস্তা, সেখানে কোনো রকমে শুয়ে পড়লাম। একটু পরপর মানুষের চলাচলের সময় গায়ে তাদের লাথি লাগছিল। আমার জ্বরে শরীর কাঁপছে, মেঝেতে জড়সড় হয়ে শুয়ে আছি। লজ্জায় মুখ ঢেকে রেখেছিলাম। ভাবলাম, আমি আমজনতা। এ দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা আমজনতার জন্য এমনই।

সকাল আটটা বেজে গেল, আমার কলিগরা দু-একজন করে আসতে লাগলেন। বললেন, পরিচালক মহোদয়কে বলে আপনাকে কেবিনে নিয়ে যাই। কিন্তু আমি বললাম, স্যার রাউন্ডে এসে দেখে কী বলেন শুনে তারপর দেখা যাবে। আমার আর খারাপ লাগছিল না, জ্বরের ঘোরে এটা-সেটা মনে হচ্ছিল। ভাবছিলাম, ধুলায় আমি একা শুয়ে নেই, সমগ্র চিকিৎসকসমাজ শুয়ে আছে। সারা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাই মেঝেতে পড়ে আছে।

মেঝেতে থাকার জন্য আমি কোনো অভিযোগ করিনি। স্বাভাবিকভাবে নিয়েছি। কারণ, রুমে কোনো বেড খালি নেই। অবশেষে রাউন্ড শুরু হলো। সহ-অধ্যাপক স্যার আমাকে অবাক করে পাশে বসে জিজ্ঞাসা করলেন সমস্যাগুলো কী। একে একে সব বললাম। তিনি আমার গায়ে হাত দিয়ে জ্বর দেখে বিরক্ত হলেন। বললেন, এটা মেডিসিনে দিতে পারত ইমার্জেন্সি থেকে। সঙ্গের চিকিৎসককে বললেন, প্রথম যে বেড খালি হবে, সেটা আমাকে দেওয়ার জন্য ফাইলে লিখে দিতে। আর বললেন, আমার কোনো কার্ডিয়াক সমস্যা নেই। বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক রইস উদ্দিন স্যারকে বলে ট্রান্সফার করে দেওয়া যেতে পারে।

সবাই যেই শুনেছে আমার কোনো কার্ডিয়াক প্রবলেম নেই, অমনি কেবিনের জন্য গেছে। আমার স্ত্রী পরিচালক মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করলে উনি দ্রুত কেবিনের ব্যবস্থা করে দেন। ফোনে রইস উদ্দিন স্যারকে জানানো হয়েছিল। পরদিন সার্জারিতে ট্রান্সফার করার জন্য তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে অনুমতি দেননি। বলেছেন ডিসচার্জ নিতে। ১৭ এপ্রিল ক্যাথ ল্যাবে জোর করে ওনার সঙ্গে দেখা করলে একই কথা বলেন। আমি তাঁকে বললাম, ‘স্যার খুব কষ্ট হচ্ছিল, তাই চলে গেছি।’ উনি ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘আমি কি বিছানা বানিয়ে দেব?’

আমি বললাম, ‘স্যার, আমি বিছানার জন্য কোনো অভিযোগ করিনি। হার্টের সমস্যা নেই জানার পর কেবিনে গেছি। দুঃখিত স্যার। আমাকে সার্জারিতে ট্রান্সফার করুন, প্লিজ!’ উনি বললেন ডিসচার্জ নিয়ে চলে যেতে। তারপর যেখানে খুশি ভর্তি হতে। ফিরে এসে ডিসচার্জ নিলাম।

আমার কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ নাই, আমি শুধু জানতে চাই:
১. কার্ডিয়াক সমস্যা নেই শোনার পর একটা চাদরে ৮ ঘণ্টা শুয়ে সারা পিঠে তীব্র ব্যথা আর জ্বরে কষ্ট সহ্য করতে না পেরে কেবিনে চলে যাওয়াটা কত বড় অপরাধ হয়েছে যে ৮ এপ্রিল থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত আমাকে হার্নিয়ার চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত রাখা হলো?
২. চিকিৎসকেরা এ জন্য মহান যে তাঁরা নিজের ঘোর শত্রুকেও মমতার সঙ্গে চিকিৎসা দেন। নিজের ভেতরে ক্ষমতার দাপট, হিংসা, অহং থাকার কোনো সুযোগ আছে কি?

অধ্যাপক রইস উদ্দিনের বক্তব্য
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে অধ্যাপক রইস উদ্দিন বলেন, ‘আমি বিষয়টি পরে দেখব বলেছি। উনি ভুল বুঝেছেন।’

ডেন্টাল সার্জন ইনচার্জ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল