অনেকেই মামলা করতে চায় না

২০১৫ সালের মাঝামাঝি। আনন্দে ভাসছেন সন্তানসম্ভবা মা। হঠাৎ নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেন স্বামী। চোখরাঙানো এমনকি মারধর শুরু হলো। তবু স্ত্রী মামলা করেননি। তিনি এখন চাকরি করছেন, কিন্তু বললেন, মামলা লড়ার সামর্থ্য নেই। পরিবারও চায় না।
নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য সরকারের মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের আওতায় পরিচালিত ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারগুলোতেও (ওসিসি) একই চিত্র। নির্যাতনের শিকার নারী-শিশু চিকিৎসা নিচ্ছে, কিন্তু মামলা করতে চাইছে না।
সরকারের বিভিন্ন পক্ষকে যুক্ত করা এই কর্মসূচির আওতায় প্রথম ওসিসি শুরু হয়েছিল ২০০১ সালে। বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নয়টি ওসিসিতে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩২ হাজারের মতো নারী ও শিশু সেবা নিয়েছে। তাদের মাত্র ২৩ শতাংশ মামলা করেছে। ওসিসির কর্মকর্তারা বলেছেন, সেবাগ্রহীতাদের বেশির ভাগ দরিদ্র।
কিন্তু ভুক্তভোগীরা আইনের আশ্রয় নিচ্ছে না কেন? মাল্টিসেক্টরাল কর্মসূচির প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেন বলছেন, এই নারীরা নিজেকেই দোষ দেন। পরিবার ও সমাজও তাঁদের চুপ করিয়ে রাখে। বিশেষত ধর্ষণের শিকার হলে। তাঁর মতে, বিচার চাওয়া জরুরি, কিন্তু রাষ্ট্রকেও অপরাধীর সাজা নিশ্চিত করতে হবে।
ওসিসি থেকে মামলা হয়েছিল প্রায় সাড়ে সাত হাজার। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ১৬ ভাগের নিষ্পত্তি হয়। সেগুলোর ১২ শতাংশে সাজা হয়েছে। ওসিসির মামলাগুলোর কিন্তু তদারকি নিবিড় হয়।

মামলায় অনাস্থা
ওসিসির কর্মকর্তারা বলছেন, বিচারের জন্য সব কটি পক্ষের সক্রিয়তা দরকার। সেখানে ঘাটতি আছে।
যেমন ভুক্তভোগী ওসিসির জরুরি হটলাইন নম্বর ১০৯-এ ফোন করে পরামর্শ নেবেন। আলামতসহ দ্রুত হাসপাতালে যাবেন, থানায় মামলা করবেন। পুলিশ দ্রুত তদন্ত করবে। বিচারের সময় সাক্ষী হাজির করবে। দ্রুত বিচার হবে। কিন্তু তা না হয়ে মামলা করে বরং ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে।
স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে একটি মানবাধিকার সংগঠনের মাধ্যমে যৌতুক নিরোধ আইনে মামলা করেছিলেন একজন নারী। মামলার খরচ চালাচ্ছেন তাঁর ভাইয়েরা। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত পুলিশকেই কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকা দিয়েছেন।
সংগঠনটি স্বামীকে দুবার ডেকে পাঠায়। তিনি আসেননি। আদালত নির্দেশ দিলেও বোঝাপড়া করেননি।

ভুক্তভোগীর পীড়ার জের
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু শল্যচিকিৎসা বিভাগে ধর্ষণের শিকার শিশুরা রক্তক্ষরণ ও যোনিতে ক্ষত নিয়ে আসে। সেখানকার চিকিৎসক কানিজ হাসিনা বলেন, ‘শিশুদের আমরা প্রচণ্ড আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় পাই। বেশির ভাগ শিশু বুঝতেও পারে না, তাদের আসলে কী হয়েছে।’ ডা. কানিজ বলছেন, বাবা-মা চিকিৎসার জন্য আনতে দেরি করেন।
গত অক্টোবরে দেশের একটি জেলায় ধর্ষণের শিকার হয়েছিল এক শিশু (৫)। তিন মাস চিকিৎসার পর সে বাড়ি ফেরে। শিশুটির বাবা বলছেন, দুবার অপারেশন লেগেছে। তবু সারাক্ষণ প্রস্রাব ঝরে। তিনি মেয়েকে স্কুলেও দেননি। বললেন, ‘যদি এ কারণে কেউ ঘেন্না করে, আমার মেয়েটা মনে কষ্ট পাবে।’
শিশুটির মানসিক কিছু বিকারও তার বাবার চোখে ধরা পড়েছে। চিকিৎসকদের পরামর্শে পরিবারটি পুরোনো এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে।