ঢাকার সড়কে বাস, চালক ও ব্যবস্থাপনা কোনোটাই ঠিক নেই

ছুটির দিনেও সড়কে বিশৃঙ্খলা। গতকাল দুপুরে ফার্মগেটের চিত্র।  ছবি: প্রথম আলো
ছুটির দিনেও সড়কে বিশৃঙ্খলা। গতকাল দুপুরে ফার্মগেটের চিত্র। ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার মানুষের প্রধান যানবাহন বাস-মিনিবাস। এই বাস, এর চালক ও চলাচলের ব্যবস্থাপনা—তিনটির কোনোটিই ঠিকঠাক নেই। সড়কে বাস নামানোর অনুমতি দেওয়া হচ্ছে কোনো রকম সমীক্ষা ছাড়া, অপরিকল্পিতভাবে। চালকেরা অদক্ষ, মাদকাসক্ত ও বেপরোয়া। আর বাস-মিনিবাসের বেশির ভাগই চলাচলের উপযোগিতাহীন (ফিটনেসবিহীন)। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে নগরে গণপরিবহনব্যবস্থায় চলছে চরম অসুস্থ প্রতিযোগিতা।

কারওয়ান বাজারের সোনারগাঁও মোড়ে এমন এক অসুস্থ প্রতিযোগিতার শিকার হয়ে প্রাণ গেছে কলেজছাত্র রাজীব হোসেনের। এর আগে ২০১৫ সালের জুনে কারওয়ান বাজারের স্টার কাবাবের সামনে দুই বাসের পাল্লাপাল্লিতে একটি বাস উল্টে গিয়ে প্রাণ হারান এক যুবক। ২০১৪ সালে মারা যান সাংবাদিক জগ্‌লুল আহ্‌মেদ চৌধূরী। তাঁকে কারওয়ান বাজারে চলন্ত বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সাড়ে তিন মাসে ঢাকায় ৫৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১১৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ২১০ জন।

সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) গবেষণায় এসেছে, যানজটের কারণে ঢাকায় এখন যানবাহনের গড় গতি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার। গত বছর বিশ্বব্যাংকের হিসাবে তা ছিল ঘণ্টায় সাত কিলোমিটার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই কম গতির শহরে এত প্রাণহানির পেছনে দায়ী চালকের বেপরোয়া মনোভাব, সড়কে পাল্লাপাল্লি এবং পরিবহন চলাচলের অনুমোদন পদ্ধতির বড় রকমের গলদ।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, ঢাকা ও এর আশপাশে ২৪৬টি পথে (রুটে) ৭ হাজার ৯৩৭টি বাস-মিনিবাস চলাচল করে। এসব বাসের মালিক আছেন প্রায় তিন হাজার। অনেক মালিকের একটি মাত্র বাস আছে, কারও কারও আছে দু-তিনটি। এসব বাস-মিনিবাসের চলাচলের অনুমোদন দেয় (রুট পারমিট) ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে গঠিত মহানগর আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি (মেট্রো-আরইটিসি)। এই কমিটির সদস্য হচ্ছেন পুলিশ, বিআরটিএ ও সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা এবং মালিক-শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি। পরিবহনমালিকেরা আবেদন করার পর ট্রাফিক পুলিশ ও মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধির মতামত এবং আবেদনকারীর প্রভাব—এই তিনটি বিষয়ই সবচেয়ে বেশি বিবেচনা করা হয়। কোন পথে কত যাত্রী চাহিদা, জনসংখ্যার ঘনত্ব ও সড়কের ধারণক্ষমতা নিয়ে কোনো সমীক্ষা হয় না। মোটর যান আইনে থাকা কতগুলো শর্ত জুড়ে দিয়ে অনুমোদন দেওয়া হয়।

অপরিকল্পিত ও অপ্রয়োজনীয় পথ (রুট) এবং অসংখ্য মালিক থাকার কারণে একই পথের বাসগুলো পাল্লাপাল্লিতে নামছে। যাত্রী তোলা ও বাস থামার ঠিক-ঠিকানাও নেই। একই কোম্পানিতে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির বাস থাকায় ওই কোম্পানির বাসগুলোও রাস্তায় কার আগে কে যাত্রী তুলবে, সেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে। অন্য গাড়ির পথ আটকে দেওয়া বা লুকিং গ্লাস ভেঙে দেওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে।

ঢাকার বেশির ভাগ বাসেরই বাইরের রং-বাকল অক্ষত নেই। বাসে ভাড়ার তালিকা নেই। বাসের ভেতরের আসন ছেঁড়া, নষ্ট ও নোংরা, পরিসর অতি ছোট। আইন অনুযায়ী, মিনিবাসে ৩১ ও বড় বাসে ৫১ আসন থাকার কথা। কিন্তু বাড়তি আয়ের আশায় ৫ থেকে ১০টি আসন বাড়িয়ে নিচ্ছেন মালিক-শ্রমিকেরা। এগুলো অনুমোদনের অন্যতম শর্ত হলেও তা মানা হচ্ছে কি না, তা দেখা হয় না।

 জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার মধ্যেই গুলশান এলাকায় ‘ঢাকা চাকা’ নামে পরিবহন চলে। ওই বাসগুলোতে কোনো আঁচড় নেই, চালকের মধ্যেও পাল্লাপাল্লির মনোভাব নেই। এর বাইরে পুরো ঢাকায় চালকেরা রাস্তায় নেমে একবার যাত্রীর দিকে চোখ দেন, পরক্ষণে দেখেন পেছনে অন্য বাস গেল কি না, সামনে অন্য বাস যাত্রী তুলছে কি না। অর্থাৎ রাস্তার দিকে কোনো চোখ নেই। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে, যানজট হয়, বিশৃঙ্খলা বাড়ে। সরকারি সংস্থা বিআরটিসির বাসও ইজারা দেওয়ার কারণে একইভাবে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এটা কঠিন অসুস্থ ব্যবস্থা।

বিআরটিএর হিসাবে, ঢাকায় বাস-মিনিবাসের নিবন্ধন ৩৫ হাজারের মতো। অর্ধেকের বেশি ঢাকার বাইরে চলে। কিছু অকেজো হয়ে বাতিল হয়ে গেছে। এই নিবন্ধিত বাস-মিনিবাসের মধ্যে সাড়ে ১৮ হাজারের ফিটনেস হালনাগাদ নেই। এর মধ্যে অন্তত পাঁচ হাজার মিনিবাস রয়েছে। ফিটনেসবিহীন এসব মিনিবাসের প্রায় সবই ঢাকায় চলছে।

বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা চারটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন। আরও আদালত বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, ৫৫ হাজার যানবাহন ১০ বছর ধরে ফিটনেস সনদ নিচ্ছে না। এক মাস সময় দেওয়া হয়েছে। এরপর সব কটির নিবন্ধন বাতিল করা হবে।

সড়কে বিশৃঙ্খলার বিষয়ে কিছুটা অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন বিআরটিএর চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, বিআরটিএ চেষ্টা করছে। কিন্তু পরিবহন খাতের সঙ্গে আরও সংস্থা জড়িত। সবাই একসঙ্গে কাজ করলেই শৃঙ্খলা আনা সম্ভব।

সড়কে গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলা বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও গতকাল বিকেলে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে অসহায়ত্বের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, তাঁর মধ্যেও অসহায়ত্ব কাজ করে। যানবাহন, চালক, যাত্রী কেউ রাস্তার শৃঙ্খলা মানে না।

পরিবহনমালিকেরা মনে করেন, ঢাকার চালকদের অর্ধেকই কম বয়সী, মাদকাসক্ত। তাঁদের অধিকাংশের বৈধ লাইসেন্স নেই। বিআরটিএর হিসাবে, সারা দেশে যানবাহন আছে ৩৩ লাখের বেশি। আর চালকের লাইসেন্স প্রায় ২০ লাখ। অর্থাৎ যানবাহনের তুলনায় চালকের লাইসেন্স কম ১৩ লাখ। সাধারণত যানবাহনের দ্বিগুণের বেশি লাইসেন্স থাকার কথা। কারণ, বাণিজ্যিক যানবাহনে একের অধিক চালক দরকার হয়। ঢাকায় চালককে চুক্তিতে বাস দিয়ে দেন মালিক। আবার বেতনের ভিত্তিতে চালক নিয়োগ দিলেও তাঁদের আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেন। এর ফলে সড়কে তাঁরা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন।

এ বিষয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, এটা সত্য, দক্ষ চালকের অভাব আছে। তাঁদের মধ্যে মাদক সেবনের হারও বেড়েছে। তাই প্রত্যেক মালিককে মাসে অন্তত দুবার চালকের সঙ্গে বসে আলোচনা করা ও সচেতনতা বৃদ্ধির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

আটকে গেছে শৃঙ্খলার উদ্যোগ

জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকা ২০১০ ও ২০১১ সালে ঢাকার গণপরিবহনব্যবস্থা নিয়ে সমীক্ষা (ডিএইচইউটিএস) করে। ২০১৪ সালে সংস্থাটি ঢাকার জন্য করা ২০ বছরের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) সংশোধন করতে গিয়ে আরেক দফা সমীক্ষা চালায়। এর আগে ২০০৪ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বিদেশি পরামর্শক দিয়ে সরকার এসটিপি প্রণয়ন করে।

এসব গবেষণা ও সমীক্ষায় ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব, যাত্রীদের যানবাহন ব্যবহারের তথ্য বিশ্লেষণ ও যানজটের কথা বিবেচনা করে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি বা বিশেষ পদ্ধতিতে বাস পরিচালনার পরামর্শ দেওয়া হয়। অর্থাৎ বিক্ষিপ্তভাবে বাসের অনুমোদন না দিয়ে পরিকল্পিত ব্যবস্থা চালুর কথা বলা হয়।

এরই অংশ হিসেবে ঢাকার প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক সব বাস ছয়টি কোম্পানির অধীনে আনার উদ্যোগ নেন। পরিবহনমালিক, সরকারি-বেসরকারি অংশীজনদের সঙ্গে ২৫-২৬টি বৈঠক করে তাঁদের রাজি করানো হয়। তিনি ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সাবেক নির্বাহী পরিচালক সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ দলকে পরিকল্পিত বাস পরিচালনার বিষয়ে প্রস্তাব তৈরি করার দায়িত্ব দেন। কিন্তু আনিসুল হকের মৃত্যুর পর উদ্যোগটি অনেকটাই থেমে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা যে পরিকল্পনা তৈরি করেছেন তাতে বলা হয়েছে, ছয়টি কোম্পানির অধীনে বাসগুলো ছয়টি পথে বিভক্ত করে দিতে হবে। প্রতিটি কোম্পানির বাসের রং থাকবে আলাদা। বিদ্যমান পরিবহনমালিকেরা এই কোম্পানিগুলোতে অন্তর্ভুক্ত হবেন। বিনিয়োগের হার অনুসারে মালিকেরা লভ্যাংশ পাবেন। এটা করা হলে পথে বাসের চালকদের মধ্যে পাল্লাপাল্লি করার প্রয়োজন হবে না।

পরিকল্পনায় আরও বলা হয়, পাঁচ বছরের বেশি পুরোনো বাস-মিনিবাসকে বাতিল ঘোষণা করতে হবে। কারণ, এগুলো চলাচলের অনুপযোগী। নতুন করে ৪ হাজার ১৫০টি বাস-মিনিবাস ও জোড়া লাগানো বাস কিনতে হবে। এর জন্য সরকার ৪ শতাংশ সুদে ঋণ সুবিধা দিতে পারে। পুরোনো বাসের মধ্যে ৩ হাজার ৭৯০টি মেরামত করে চালানো সম্ভব। সব মিলিয়ে ঢাকার জন্য ৭ হাজার ৯৪০টি বাস-মিনিবাস ও জোড়া লাগানো বাসের একটা বহর থাকবে। সব মিলিয়ে ৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটি সরকার, পরিবহনমালিকদের মূলধন এবং ব্যাংকঋণের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে।

এই পরিকল্পনা অবহিত করতে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক ও পরিবহননেতারা অর্থমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেন। গত বছরের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এই পরিকল্পনা তুলে ধরা হলে তিনি এটি বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। এরপর ২৫ জুলাই মহাখালী বাস টার্মিনালে পরিবহনমালিকেরাও এক সভায় এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সায় দেন। গত নভেম্বর মাসে আনিসুল হক মারা যাওয়ার পর প্রকল্পটি আর এগোয়নি।

ঢাকার বাস্তব অবস্থা

গত প্রায় এক যুগে ঢাকার জন্য যত পরিকল্পনা বা সমীক্ষা করা হয়, এর সব কটিই ঢাকার মূল গণপরিবহন হিসেবে বাস-মিনিবাসের কথা উঠে এসেছে। মেট্রোরেল, উড়ালসড়কসহ অন্য প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও বাস-মিনিবাসের চাহিদা কমবে না বলে সমীক্ষায় এসেছে।

জাইকার সমীক্ষা বলছে, ২০১৪ সালের হিসাবে ঢাকা শহরে যানবাহনে চলাচলকারী যাত্রীদের ৪৭ শতাংশ চলে বাস-মিনিবাসে। ২০২৫ সালে ৫৯ শতাংশ যাত্রী পরিবহন হবে বাস-মিনিবাসে। ২০৩৫ সালে এই সংখ্যা হবে ৫৭ শতাংশ।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, ঢাকায় বাস চলাচলের অনুমতি দেওয়ার পদ্ধতি অবৈজ্ঞানিক। বাস পরিচালনা করা হচ্ছে ভুল পদ্ধতিতে। এ পর্যন্ত হওয়া প্রায় সব গবেষণাতেই বলা হয়েছে, বাসের কোম্পানি হবে কম, অনুমোদন দিতে হবে সড়কের চাহিদা সমীক্ষা করে। এটা নিশ্চিত না করতে পারলে যে যত কথাই বলি, কোনো লাভ নেই।