প্রকল্পের খরচে শিক্ষা সফরেই যত আগ্রহ

প্রকল্পের অর্থায়নে তিনটি আন্তর্জাতিক শিক্ষাসফরে খরচ হয়েছে ৮৯ লাখ টাকা। তবে শিক্ষাসফর থেকে কর্মকর্তারা যা শিখে এসেছেন, তা বাস্তবায়নে নতুন করে অর্থ বরাদ্দের আবেদন জানানো হবে।

আবার শিক্ষাসফরে গেছেন মূলত শীর্ষ কর্মকর্তারাই। কোনো প্রশিক্ষককে কোনো শিক্ষাসফরেই নেওয়া হয়নি। কারণ, প্রশিক্ষকেরা ইংরেজি জানেন না। এ নিয়েও রয়েছে নানা আলোচনা।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় মহিলা সংস্থার নগরভিত্তিক প্রান্তিক মহিলা উন্নয়ন প্রকল্পের (দ্বিতীয় পর্যায়) খরচে এই শিক্ষাসফর অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে সরকারি অর্থায়নের প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়। প্রকল্পটি ২০২০ সাল পর্যন্ত চলবে।

প্রকল্প পরিচালক নূরুন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প মেয়াদে দুটি আন্তর্জাতিক মেলা এবং ছয়টি শিক্ষাসফর হওয়ার কথা। এতে বরাদ্দ দুই কোটি টাকা। এর মধ্যে গত বছর লন্ডন ও ইন্দোনেশিয়ায় এবং চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মোট তিনটি সফর অনুষ্ঠিত হয়েছে। লন্ডন সফরে ব্যয় হয়েছে ৩৭ লাখ টাকা, ইন্দোনেশিয়ায় ৩৩ লাখ টাকা এবং মালয়েশিয়ায় খরচ ১৯ লাখ টাকা। প্রকল্প প্রস্তাবেই (ডিপিপি) ‘স্টাডি ট্যুর ওভারসিজ’ নাম দিয়ে এ ধরনের ট্যুরের অনুমোদন দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।

প্রকল্পের মূল কাজ হলো শহরভিত্তিক দরিদ্র, দুস্থ ও বিত্তহীন নারীদের যথোপযুক্ত দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে উৎপাদনমুখী, কর্মক্ষম ও আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তোলা। এ জন্য ৭৫টি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে সেলাই ও এমব্রয়ডারি, ব্লক-বাটিক ও স্ক্রিন প্রিন্ট, মোবাইল সার্ভিসিং, বিউটিফিকেশনসহ ১০টি খাতে নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দাবি করছেন, প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষকদের দক্ষতা বাড়ানো, নতুন যন্ত্রপাতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং তা প্রকল্পে কাজে লাগানোর জন্যই শিক্ষাসফরগুলোর উদ্দেশ্য। তবে তিনটি সফরেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, মন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, সচিব, জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য কর্মকর্তা গেলেও কোনো প্রশিক্ষক এতে অংশ নেননি।

প্রকল্প পরিচালক নূরুন নাহার এর কারণ সম্পর্কে প্রথম আলোকে বলেন, প্রশিক্ষকেরা ইংরেজি জানেন না। তাই তাঁদের বিদেশ নিয়ে গেলেও কিছু বুঝতে পারবেন না। তবে পরবর্তী সফরে প্রশিক্ষকদের নেওয়া হবে এবং বিদেশ থেকে প্রশিক্ষক এনেও তাঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজও প্রথম আলোকে বলেছেন, এ ধরনের ট্যুরে প্রশিক্ষকদের নিয়ে গেলেই যে তাঁরা সব শিখে ফেলবেন তা নয়। প্রশিক্ষকদের জন্য একটু সময় বেশি দিয়ে বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে।

 তিন সফরের অভিজ্ঞতা ও বাস্তবায়ন

লন্ডন সফর নিয়ে কোনো লিখিত প্রতিবেদন নেই প্রকল্পের কাছে। প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজের নেতৃত্বে লন্ডনে প্রতিনিধিদল খাদ্য তৈরি ও প্রক্রিয়াজাতকরণ বিভিন্ন বিষয় পরিদর্শন করে। তবে প্রকল্প পরিচালক নূরুন নাহার বলেন, লন্ডনের যে অভিজ্ঞতা তা বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব। কেননা এটি অনেক খরচের ব্যাপার।

ইন্দোনেশিয়া সফরেরও নেতৃত্ব দেন মেহের আফরোজ। প্রতিনিধিদল মোমবাতি ও শোপিস তৈরির কৌশল দেখার পাশাপাশি কিছু নমুনাও সংগ্রহ করে। এ ছাড়া প্রতিনিধিদলের সদস্যরা ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের বিখ্যাত স্থাপনাও দেখে এসেছেন।

আর গত ফেব্রুয়ারি মাসের মালয়েশিয়া সফরের নেতৃত্বে ছিলেন মন্ত্রণালয়ের সচিব নাছিমা বেগম। এখানেও তাঁরা মেশিনের সাহায্যে মোমবাতি বানানো, এমব্রয়ডারি কারখানাসহ বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শন করেন।

শিক্ষাসফর কতটা কাজে লাগছে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এ ধরনের সফরে কিছু না কিছু অভিজ্ঞতা হয়। তবে দেশে ফিরে তার বাস্তবায়ন কতটুকু হলো, তা দেখতে হবে।

সর্বশেষ সফরের অভিজ্ঞতা নিয়ে জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান অধ্যাপক মমতাজ বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তো ভালোভাবে হাঁটতে পারি না। তাই পরিদর্শনের জায়গায় যেতে পারিনি। আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি।’

নূরুন নাহার বলেন, ‘সফরের অভিজ্ঞতা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে বলা যায়। প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় থেকে আমার উদ্যোগেই নতুন করে শিক্ষাসফর শুরু হচ্ছে। আমাদের দেখে এখন অন্য প্রকল্পেও এ ধরনের শিক্ষাসফর রাখা হচ্ছে।’

দুর্নীতি প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কোনো কিছু শেখার জন্য প্রকল্পের আওতায় বিদেশ ভ্রমণের বিষয়টি থাকতে পারে। তবে ভ্রমণের লব্ধ জ্ঞান প্রয়োগে যথাযথ কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। বিদেশ ভ্রমণে কারা যাবেন, তার জন্য সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি থাকতে হবে। যদি তা না হয়, তাহলে অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই হবে না।