ঢাকার দেয়ালে নতুন গ্রাফিতি: লাল-সবুজই শেষ সম্বল

নতুন এই দেয়ালচিত্র আঁকা হয়েছে কাকলীর পদচারী–সেতুর পুব দিকের দেয়ালে।  ছবি: প্রথম আলো
নতুন এই দেয়ালচিত্র আঁকা হয়েছে কাকলীর পদচারী–সেতুর পুব দিকের দেয়ালে। ছবি: প্রথম আলো
>

• ঢাকার দেয়ালে আলোচিত ‘সুবোধ’ সিরিজের নতুন দেয়ালচিত্র 
• আঁকা হয়েছে স্টেনসিল ব্যবহার করে 
• রাজনৈতিক বা সামাজিক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার শিল্পিত মাধ্যম গ্রাফিতি

কাকলীতে পদচারী-সেতুর পূর্ব দিকের ফুটপাত ধরে মহাখালীর দিকে এগোতেই চোখ আটকে যাবে ফুটপাত-সংলগ্ন সাদা দেয়ালের জমিনে। প্রাচীরের ক্যানভাসে আঁকা বিষাদগ্রস্ত এক কিশোরীর অবয়ব। নকশাদার ফ্রেমে বাঁধানো লাল-সবুজের পতাকা। পতাকার গায়ে ঈষৎ কালো ছায়া। কিশোরী ফ্রেমসমেত সেই পতাকাটি বুকে আঁকড়ে ধরে আছে পরম মমতায়। ছবির পাশে লেখা ‘দিস ইজ মাই মাস্টারপিস (এটা আমার শ্রেষ্ঠ কর্ম) ’।

ঢাকার দেয়ালে আলোচিত ‘সুবোধ’ সিরিজের নতুন এই দেয়ালচিত্র বা গ্রাফিতিটি মনোযোগ কাড়ছে অনেক পথচারীর। কোনো রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার শিল্পিত একটা মাধ্যম হিসেবে অনেক দেশে এটা পরিচিত।

কাকলীর নতুন এই দেয়ালচিত্রে বিরূপ সময়ের বার্তা নিয়ে হাজির হওয়া সুবোধের উপস্থিতি নেই। কিন্তু এর অঙ্কনপদ্ধতি একই রকম। সুবোধ সিরিজের চিত্রগুলোর মতো এটাও আঁকা হয়েছে স্টেনসিল (লেখা বা আঁকার জন্য ছিদ্রময় পাত) ব্যবহার করে। আর আগের মতোই এই দেয়ালচিত্রের নিচে লোগো আকারে ব্যবহার করা হয়েছে একটি শব্দ: ‘হবেকি?’ (HOBEKI?)। নতুন এই গ্রাফিতি দেখে বোঝা যায়, পলায়নপর চরিত্র সুবোধের আঁকিয়ে আর নতুন এই দেয়ালচিত্রের আঁকিয়ে কিংবা আঁকিয়েরা একই। সুবোধের মতোই যাঁর বা যাঁদের পরিচয় এখন পর্যন্ত উদ্ঘাটিত হয়নি।

নতুন এই দেয়ালচিত্র নিয়ে কথা হয় চিত্র সমালোচক মোস্তাফা জামানের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে এই গ্রাফিতির শিল্পী বা শিল্পীদের নিজস্ব অনুভূতিই চিত্রটিতে ফুটে উঠেছে।

মোস্তাফা জামান আরও বলেন, ছবিটি দেখে মনে হয়, সব হারানো বিষাদগ্রস্ত কিশোরীটি এই দেশটাকেই তার বুকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে। বলছে, এটাই তার শেষ সম্বল। চিত্রিত ফ্রেমে বাঁধানো পতাকাটিকে সে অভিহিত করেছে মাস্টারপিস বা শ্রেষ্ঠ কাজ হিসেবে। এটা আশাবাদের প্রতীক।

বিভিন্ন দেশে প্রতিরোধ আন্দোলনে গ্রাফিতি অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠার নজির আছে। নিকট অতীতে দিল্লির ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, যুক্তরাষ্ট্রের অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন, ইসরায়েলবিরোধী আন্দোলন কিংবা সম্প্রতি কলকাতার যাদবপুরে শিক্ষার্থী নিগ্রহের প্রতিবাদে ‘হোক কলরব’ আন্দোলনেও ছিল গ্রাফিতির উপস্থিতি।

এর আগে ফেসবুকসহ গণমাধ্যমের নানা পরিসরে সুবোধের গ্রাফিতি নিয়ে আলোচনার মধ্যেই এটা নিয়ে তথ্যচিত্র বানান পার্থ প্রতীম দাস নামের এক শৌখিন নির্মাতা। সুবোধ উঠে আসে অনেক তরুণের টি-শার্টে। সুবোধের এই গ্রাফিতি নিয়ে ‘সুবোধ কেন পালাবে?’ এবং ‘এবার ভোরের অপেক্ষায় সুবোধ’ শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রথম আলো। গত বছরের মার্চ-এপ্রিল থেকে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গার দেয়ালে আঁকা সুবোধ কখনো বাক্সবন্দী সূর্য হাতে পালাতে উদ্যত, কখনো জেলে বন্দী, কখনো হতাশায় নুয়ে পড়া এক মানুষ। আবার একটি চিত্রে প্রজন্মের কণ্ঠে ভোরের আশাবাদের কথাও তুলে এনেছিল সে।

ঢাকার দেয়ালে আঁকা ‘সুবোধ’ সিরিজের দেয়ালচিত্রগুলোর অনুপ্রেরণায় কলকাতার প্রেসিডেন্সি ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা তাঁদের ক্যাম্পাসে চিত্রিত করেন একাধিক গ্রাফিতি। এই শিক্ষার্থীরা ঢাকার ‘সুবোধ’কে দেখেছেন তাঁদের দাবি আদায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতীক হিসেবে। তবে ঢাকার গ্রাফিতি আঁকিয়েরা এখন পর্যন্ত অপ্রকাশ্য ও রহস্যময় হয়ে থাকলেও কলকাতায় যাঁরা সুবোধকে এঁকেছেন, তাঁরা সবাই প্রকাশ্য। আঁকার ঢঙেও রয়েছে পার্থক্য।

গত বছরের ২০ আগস্ট ঢাকায় সুবোধের দেয়ালচিত্রগুলো নিয়ে ভারতের ইংরেজি দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ তাদের সাময়িকী ‘সেভেন ডেজ’-এ ‘হবেকি? (HOBEKI?)’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে প্রতিবেদক উপলা সেন ঢাকায় সুবোধের দেয়ালচিত্র নিয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও দর্শন হাজির করার পাশাপাশি এর অনুপ্রেরণায় কলকাতার গ্রাফিতি আঁকিয়ে ও তাঁদের নিজস্ব ভাবনা তুলে ধরেন।

গ্রাফিতির ইতিহাস এতই পুরোনো যে প্রাচীন মিসর, গ্রিস ও রোমান সাম্রাজ্যে এর নিদর্শন পাওয়া যায়। এই শিল্পকর্মগুলোর মূল উপজীব্য সমসাময়িক বিভিন্ন রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক ঘটনা। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের ভেতর দিয়ে কখনো এগুলোতে ফুটিয়ে তোলা হয় যুদ্ধবিরোধী বক্তব্য কিংবা শান্তির বার্তা হিসেবে। কখনো এটি হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, প্রচলিত নীতি কিংবা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শৈল্পিক রূপ হিসেবে। এ কারণেই হয়তো কোনো কোনো দেশে গ্রাফিতি নিষিদ্ধ।