ঢাকার রামপুরার উলন রোডে এক গলিতে ১৮ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

রামপুরার উলন রোডে প্রায় এক কিলোমিটার  পথের দুই পাশে ১৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিকেলে এর অনেকগুলো হয়ে যায় কোচিং সেন্টার। স্কুল শুরু  আর ছুটির সময় এই রাস্তায় মানুষ আর যানবাহনের জট লেগে যায়।  ছবি: প্রথম আলো
রামপুরার উলন রোডে প্রায় এক কিলোমিটার পথের দুই পাশে ১৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিকেলে এর অনেকগুলো হয়ে যায় কোচিং সেন্টার। স্কুল শুরু আর ছুটির সময় এই রাস্তায় মানুষ আর যানবাহনের জট লেগে যায়। ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার রামপুরার উলন রোডে কিন্ডারগার্টেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা মিলে ১৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এগুলোর কয়েকটির নামের সঙ্গে কলেজ থাকলেও বাস্তবে বেশির ভাগেরই মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ারও সুযোগ নেই। নিবন্ধন নেই বলে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে হয় এমপিওভুক্ত অন্য স্কুলে নিবন্ধন করে।
উলন রোডের এই অংশটি এক কিলোমিটারেরও কম। এতটুকু জায়গায় ১৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলেও শিক্ষার্থীর কমতি নেই। ফলে স্কুল শুরু আর ছুটির সময় রাস্তায় রিকশা, স্কুলভ্যান, গাড়ি আর মানুষে মিলে জট লেগে যায়।
বাসিন্দারা বলছেন, উলন এলাকাটি ঘনবসতিপূর্ণ। কারণ, অন্য এলাকার তুলনায় এখানে ভাড়া কিছুটা কম। রামপুরার এই এলাকা ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের (গুলশান থানা) অধীনে। সেখানকার কর্মকর্তারা জানালেন, গুলশান এলাকায় ৩৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। তবে রামপুরা এলাকায় কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই।
উলন রোডের বিদ্যালয়গুলো হলো সিটি আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মাদারল্যান্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজ, কোয়ালিটি লারনার্স হাইস্কুল, সপ্তবর্ণ বিদ্যানিকেতন, রামপুরা আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, অ্যাডভান্সড নিউ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, হলি ভিশন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, খালেদ হায়দার মেমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয়, ব্রাইট স্টার গ্রামার হাইস্কুল, ব্রাইট স্টার কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড হাইস্কুল, রূপায়ণ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রামপুরা একরামুন্নেছা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, রামপুরা একরামুন্নেছা উচ্চবিদ্যালয় এবং রামপুরা একরামুন্নেছা ডিগ্রি কলেজ। মাদ্রাসাগুলো হলো রামপুরা জাতীয় মহিলা মাদ্রাসা, রওজাতুল কুরআন মাদ্রাসা, জামিয়া ইসলামিয়া শায়খ জাকারিয়া ও জামিয়া কারিমিয়া আরাবিয়া।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বিদ্যালয়গুলোর ছয়টির নামের সঙ্গে কলেজ যুক্ত আছে। তবে এগুলোর কোনোটিতেই কলেজের কার্যক্রম নেই। অধিকাংশ বিদ্যালয়ই ভাড়া বাসায় পরিচালিত হয়। শরীরচর্চার আলাদা জায়গা নেই; জাতীয় সংগীত এবং শপথ পাঠ হয় শ্রেণিকক্ষেই। অনেক প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষ প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। দিনের বেলায় বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয়। এসব শ্রেণিকক্ষের অনেকগুলোর দেয়ালের রং উঠে গেছে। কয়েকটিতে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শেষ হলে বিকেল থেকে চলে কোচিং কার্যক্রম।
কিন্ডারগার্টেনে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা হয়। বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রামপুরার দাউদ হায়দার মেমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয়, রামপুরা একরামুন্নেছা বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও রামপুরা একরামুন্নেছা বালক উচ্চবিদ্যালয় এমপিওভুক্ত (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) ও নিজস্ব ভবনে পরিচালিত হয়।
কোয়ালিটি স্কুলে কেজি ওয়ানে ভর্তি হয়েছিল জাফরীন সুলতানা। এখন পড়ছে তৃতীয় শ্রেণিতে। জাফরীন বলল, বড় ও ভালো স্কুলগুলো এলাকার বাইরে ও দূরে। বাসার কাছে থাকায় এ স্কুলে পড়ছে সে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এখানে পড়ার পর অন্য স্কুলে ভর্তি করাবে বলে জানিয়েছেন তার মা-বাবা।
অ্যাডভান্সড নিউ মডেল স্কুলের প্রবেশপথে কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয়। সীমা রায় নামের এক অভিভাবক বলেন, স্কুলটি বাসার কাছে হওয়ায় তিনি সন্তানকে ভর্তি করিয়েছেন। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ আছে। এরপর অন্য কোথাও ভর্তি করাবেন।
খালেদ হায়দার মেমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হরিপদ সরকার বলেন, কিন্ডারগার্টেন স্কুলের কারণে তাঁদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে। কোনো কোনো কিন্ডারগার্টেন দু-তিনটি কক্ষ নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালায়। কিছু স্কুল ভর্তিতে ফি নেয় না, কিন্তু পরে ঠিকই কোচিং করিয়ে সে টাকা আদায় করে নেয়। তিনি জানান, কিন্ডারগার্টেনগুলোতে অষ্টম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষা দেওয়ার জন্য অনুমোদন না থাকায় সেখানকার পরীক্ষার্থীরা নিবন্ধিত বিদ্যালয় থেকেই পরীক্ষা দেয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শিক্ষক বলেন, মূল সমস্যা, প্রশিক্ষিত শিক্ষক নেই। ছাত্ররাই শিক্ষক। ক্লাসরুমে ছাত্রদের বসার বেঞ্চ থেকে লেখার বোর্ড ৬ মিটার দূরে রাখার যে শর্ত আছে, তা-ও মানা হয় না। অভিভাবকেরা বাইরের চাকচিক্য দেখে ভর্তি করিয়ে দেন। শ্রেণিকক্ষে কিছু পড়ানোর পর বাকিটা কোচিং করানো হয়।
এখানকার একটি স্কুলে কয়েক বছর শিক্ষকতা করে সপ্তবর্ণ বিদ্যানিকেতন নামে নতুন স্কুল দিয়েছেন চার নারী শিক্ষক। এর প্রধান শিক্ষক জান্নাতুল নাঈম বলেন, ২০১৪ সালে এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁরা। এখনো নিবন্ধন পাননি। নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা হবে বলে জানান তিনি।
কিন্ডারগার্টেনগুলোতে ভর্তি ফি ২ হাজার থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০০ থেকে ৭৫০। মাসিক বেতন ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। আবার আলোচনা সাপেক্ষে কয়েকটি বিদ্যালয়ে ভর্তি ফি কম নেওয়া হয়। প্রতিটি বিদ্যালয়ে দিবা ও প্রভাতি শাখা চলে।
ঢাকা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (গুলশান থানা) খান মাহসুরা আক্তার বলেন, উলন রোডের বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলোর নিবন্ধন নেই। তবে এগুলোর একটি এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (ইএমআইএস) কোড আছে। এই কোডের মাধ্যমে বিদ্যালয়সমূহ অনলাইনে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অন্তর্ভুক্ত হয়। সেখানে এসব বিদ্যালয়ের যাবতীয় তথ্য লিপিবদ্ধ থাকে। তবে এটি কোনো নিবন্ধন নয়। সরকারি পাঠ্যক্রমের বই দেওয়া, সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেওয়া এবং হিসাবের জন্য এই তালিকা রাখা হয়। পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষা দেওয়ার জন্যও এই কোড চলে।
যোগাযোগ করা হলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালক ইন্দু ভূষণ দেব প্রথম আলোকে বলেন, এসব বিদ্যালয়ের অনেকগুলো প্রাথমিক সনদের শর্তগুলো সঠিকভাবে মানেনি। শহরের ক্ষেত্রে নিবন্ধনের শর্ত হলো, নিজস্ব ভবন থাকতে হবে। তবে ভাড়া ভবনে বিদ্যালয় হলেও তা অন্তত সাড়ে ৩ হাজার বর্গফুট হতে হবে। অন্তত ছয়টি শ্রেণিকক্ষ থাকতে হবে। যে জায়গায় বিদ্যালয় হবে তা অন্তত ৮ শতাংশ ভূমির ওপর হতে হবে। স্কুলের জন্য প্রশিক্ষিত শিক্ষক ও নিজস্ব তহবিল থাকতে হবে।
ইন্দু ভূষণ দেব আরও বলেন, ‘অধিদপ্তরের একজনের পক্ষে এত বেশি বিদ্যালয় পরিদর্শন করা সম্ভব নয়। এ কারণে নীতিমালায় আমরা পরিদর্শনের জন্য নতুন প্রস্তাব দিয়েছি। এতে বলা হয়েছে, জেলা শিক্ষা অফিসের অন্য কর্মকর্তারাও পরিদর্শনে যেতে পারবেন। তবে তা অনুমোদন পায়নি।’
মাদারল্যান্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল বাছেত মনে করেন, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দিতে না পারলে শিক্ষার মান খারাপ হবে। অনেক স্কুল হয়েছে, তাই শিক্ষার্থী কমছে। অনেক স্কুল শিক্ষকদের দেড়-দুই হাজার টাকাও দিতে পারে না। এ কারণে অনেক স্কুলের পাঠদানের মান ভালো রাখা যায় না।
একই দেয়ালের দুই পাশে দুই স্কুল। হলি ভিশন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও অ্যাডভান্সড নিউ মডেল স্কুল। একটি স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক অভিভাবক বলেন, ‘মেয়ের ক্লাস সকালে শেষ হয়ে যায়। এরপর বিকেল ৪টা থেকে একই স্কুলে কোচিং পড়তে আসে।’
অ্যাডভান্সড নিউ মডেল স্কুলে পরীক্ষা শেষে বের হয়েছে আনিকা শাহরীন, ইশরাত জাহান ও তার সহপাঠীরা। তারা বলল, দূরের স্কুলগুলোতে ভর্তি হতে পারেনি, এ কারণে অ্যাডভান্সড নিউ মডেল স্কুলে পড়ছে।
নিউ ভিশন বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলেন, শিক্ষকদেরও সবার শিক্ষাদানের প্রশিক্ষণ বা নিবন্ধন নেই। আগে অন্য বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের অভিজ্ঞতা এবং বিশ্ববিদ্যালয় বা ডিগ্রি পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাই এখানকার শিক্ষক হতে পারেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষক বলেন, তিনি একটি ডিগ্রি কলেজে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পড়ছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁর মতে, স্কুলে পড়ালে নিজের পড়া হয়, আবার চাকরির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাও বাড়ে।
এই বিদ্যালয়গুলো কোনো তদারকির মধ্যে আছে কি না, জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালক ইন্দু ভূষণ দেব বলেন, বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো তদারকির জন্য অধিদপ্তরের জনবল খুবই কম। এ কারণে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এসব বিদ্যালয় তদারকিতে যাওয়া হয়নি। তিনি বলেন, কেবল ঢাকা শহরেই সাড়ে ৮ হাজারের বেশি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। অনেকে এমন জায়গায় স্কুল করেছেন, যেখানে স্কুল চালানোর পরিবেশও নেই। এ জন্য অনেকে বিদ্যালয়ের অনুমোদন নিতে আসেনও না।