'নিবন্ধনে' চলে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা

আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, লালবাগ, চকবাজার, বংশাল এলাকায় দেদার চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। এই নিষিদ্ধ যানগুলো অবাধে চলাচলে ‘নিবন্ধনের’ নামে মাসে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।

ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো বিভিন্ন এলাকায় চললেও নিবন্ধনের মূল কাজ হয় কামরাঙ্গীরচরে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৫, ৫৬ এবং ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড মিলে কামরাঙ্গীরচর। সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা জানান, এসব এলাকায় কমবেশি ৪ হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশা চলে।

অভিযোগ রয়েছে, মাস শেষে কেবল ব্যাটারিচালিত রিকশা ‘নিবন্ধন’ করে কমপক্ষে ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন কয়েক ব্যক্তি। আর রিকশার নিবন্ধন থেকে আয়ের টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা হয় কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, লালবাগ, চকবাজার, বংশাল থানা, সংশ্লিষ্ট এলাকার কাউন্সিলর এবং রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে।

চালকেরা বলেন, এই রিকশাগুলো অবাধে চলতে ‘নিবন্ধন’ দরকার। নিবন্ধনে মাসে ব্যাটারিচালিত রিকশাপ্রতি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা করে নেওয়া হয়। এর বিনিময়ে একটি কার্ড দেওয়া হয়, যার মেয়াদ এক মাস। এই কার্ডগুলো ব্যাটারিচালিত রিকশার পেছনে লাগানো হয়। কার্ড থাকলে পুলিশ এসব রিকশা চলাচলে বাধা দেয় না।

যেভাবে চলে ‘নিবন্ধন’

কামরাঙ্গীরচরের তিনটি ওয়ার্ডজুড়ে ব্যাটারিচালিত রিকশার গ্যারেজগুলোর অবস্থান। এখানে গ্যারেজের সংখ্যা ১ হাজার ২০০-এর বেশি। ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো এই গ্যারেজগুলোতেই থাকে।

রিকশা ও গ্যারেজের মালিকেরা জানান, ব্যাটারিচালিত রিকশার ‘নিবন্ধন’ গ্যারেজের মাধ্যমেই হয়। চালকদের ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা করে জমা দিতে হয় সংশ্লিষ্ট গ্যারেজে। গ্যারেজের মালিকেরা, ওই টাকা নিবন্ধনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের কাছে দেন। টাকা জমা পড়লে গ্যারেজগুলোতে আসে কার্ড। এতে নিবন্ধনের নম্বর, যে ব্যক্তির মাধ্যমে নিবন্ধন হয়েছে তাঁর মুঠোফোন নম্বর এবং ইলিশ মাছ, কবুতর, ময়ূর, রিকশার ছবি ঠাঁই পায়। এই কার্ড ব্যাটারিচালিত রিকশার পেছনে লাগানো থাকে, যা বাধাহীনভাবে অবৈধ রিকশা চলার টিকিট।

চালকেরা বলেন, কোনো পুলিশ সদস্য রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশা ধরলে কার্ডে থাকা মুঠোফোন নম্বরে ফোন দিতে বলা হয়। তখন নিবন্ধনকারীরা বিষয়টি পুলিশের সঙ্গে মিটমাট করে নেন।

কামরাঙ্গীরচরে পাঁচ বছর ধরে রিকশা চালান রাজশাহীর আলী ফকির। প্রথম তিন বছর প্যাডেলচালিত রিকশা চালালেও বছর দুই ধরে তিনি ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান। তিনি বলেন, ‘গাড়িতে কার্ড থাকলে পুলিশ আটকায় না। আর আটকালেও ঝামেলা মিটমাটের দায়িত্ব কার্ডদাতার। যদিও শরীরের কষ্ট কমে, তা-ও টাকা দিতে খারাপ লাগে।’

কামরাঙ্গীরচরের নবীনগরে পাঁচ কাঠা জমি ভাড়া নিয়ে রিকশার গ্যারেজ তুলেছেন মো. জয়নাল আবেদীন। তাঁর মালিকানাধীন ১০০ রিকশার মধ্যে ৪০টি ব্যাটারিচালিত। তিনি বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত রিকশা অবৈধ। এই ব্যবসা চালাতে নানান ঝক্কিঝামেলা, খরচও মেলা।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক গ্যারেজ মালিক বলেন, ‘নিবন্ধনের টাকা তো আছেই, এর বাইরে প্রতি মাসে পুলিশকে ১০০ টাকা এবং স্থানীয় নেতাদের টাকাপয়সা দিয়েই ব্যবসা চালাতে হয়।’

গত অক্টোবরে এই অবৈধ রিকশা বন্ধ করতে গিয়ে ক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. সাইদুল ইসলাম। তিনি তাঁর এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের জন্য এক মাস সময় বেঁধে গত বছরের ৩ অক্টোবর তাঁর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। পরে ২৮ তারিখ তাঁর কার্যালয় ঘিরে কয়েক শ রিকশাচালক তাঁর বিরুদ্ধে মিছিল করেন।

যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ

নিবন্ধনের নামে টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে কামরাঙ্গীরচরের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি পারভেজ হোসেন (বিপ্লব), ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ কর্মী মো. সজীব হোসেন, কাশেম নামে এক ব্যক্তি, যিনি স্থানীয়ভাবে চকলেট কাশেম নামে পরিচিত, শ্যামল মাতবর, আবদুল ছাত্তার, লালবাগ শহীদনগরের মো. সোহরাব ও রফিকের বিরুদ্ধে। নিবন্ধনের নামে যাঁরা টাকা নেন, তাঁদের মধ্যে পারভেজ, সজীব ও সোহরাবের নামডাক বেশি।

যোগাযোগ করা হলে সোহরাব নিজেকে রিকশা তৈরির কারিগর পরিচয় দিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তো দেড় মাসে আগে এই (ব্যাটারিচালিত রিকশার নিবন্ধন) ব্যবসা ছাইড়া দিছি। ছাড়ার আগে সবাইরে বলছি আমি আর দায়িত্বে নাই। পুলিশে ধরলে কিছু করতে পারব না।’ তবে তাঁর ফোন নম্বর দিয়ে কার্ড এখনো কেন চলছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার নাম বেঁইচা অনেকে ব্যবসা চালাচ্ছে।’

৫৬ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি পারভেজ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি কল রিসিভ না করে কেটে দিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে কামরাঙ্গীরচর থানায় দুটি মামলা রয়েছে। মামলা রয়েছে ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডের মো. সজীব হোসেনের বিরুদ্ধেও।

এই ব্যবসার টাকার অন্যতম ভাগীদার হিসেবে এসেছে কামরাঙ্গীরচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) নাম। এ বিষয়ে ওসি শাহীন ফকির প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই অভিযোগ মিথ্যা। এই বিষয়ে পুলিশের সম্পৃক্ততার তথ্য দিতে পারলে আমি নিজে ব্যবস্থা নেব।’