রোহিঙ্গা নিয়ে মিয়ানমারের নানা ছলে সময়ক্ষেপণ

বাংলাদেশ–মিয়ানমার সীমান্তের শূন্যরেখায় কাঁটাতারের বেড়ার কাছে রোহিঙ্গাদের জমায়েত। গতকাল রাখাইন রাজ্যের মংডুতে। ছবি: এএফপি
বাংলাদেশ–মিয়ানমার সীমান্তের শূন্যরেখায় কাঁটাতারের বেড়ার কাছে রোহিঙ্গাদের জমায়েত। গতকাল রাখাইন রাজ্যের মংডুতে। ছবি: এএফপি
>
  • রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে।
  • রোহিঙ্গাদের জন্য সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি নেওয়ার কথা ভাবতে হচ্ছে
  • রোহিঙ্গাদের ফেরাতে সময় নষ্ট করছে মিয়ানমার

বাংলাদেশের সঙ্গে প্রত্যাবাসন চুক্তি সইয়ের পর পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে নানা অজুহাতে সময় নষ্ট করছে মিয়ানমার। আর রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে স্থানীয় জনগণ ও ভূমির ক্ষতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর কোনো মাথাব্যথা নেই। বরং এসব সংস্থা কক্সবাজারের খালি জমিতে রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপনে উৎসাহিত করছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের জন্য সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি নেওয়ার কথা ভাবতে হচ্ছে।

‘অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারী মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের চিহ্নিতকরণ-সংক্রান্ত বিভাগীয় কমিটির’ এক প্রতিবেদনে সম্প্রতি ওই অভিমত দেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারে যেসব সমস্যা তৈরি হয়েছে, সেগুলোর উল্লেখ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। পুলিশ এ পর্যন্ত ১ হাজার ১২০ জন রোহিঙ্গাকে বিভিন্ন জায়গা থেকে আটক করে কক্সবাজারে পাঠিয়েছে। এ ছাড়া কক্সবাজার জেলা থেকে ৫২ হাজার ৩৪৬ জন ও অন্যান্য জেলা থেকে ২ হাজার ৮৩৯ জনকে উদ্ধার করে শিবিরে স্থানান্তর করা হয়েছে। আবার বর্ষা ঘনিয়ে আসায় সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে। পাহাড় কেটে রোহিঙ্গা শিবির করার ফলে বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ধসের আশঙ্কা রয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের মতে, এ জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের কারণে পরিবেশ, প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলাদেশের ভূমি, পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রামের প্রায় ৫.০১৩ একর বনভূমি রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এ পর্যন্ত জীববৈচিত্র্যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩৯৮ কোটি টাকা। বন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় হাতির পাল লোকালয়ে এসে জনসাধারণের ক্ষতি করছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, আমরা মিয়ানমারের পক্ষ থেকে কোনো আন্তরিকতা লক্ষ করছি না। এ কারণে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে জানিয়েছি। কারণ দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি না থাকলে যেকোনো বিপদের আশঙ্কা আছে। বিশেষ করে ভূমিধস বা অন্য কিছু হলে বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে পারে। এ ছাড়া তারা যদি সহজে ভোটার হয়ে যায় বা পাসপোর্ট পায়, তবে তাদের থেকে যাওয়ার আগ্রহ আরও বাড়বে। সব বিবেচনায় বিষয়গুলো গুরুত্ব দেওয়ার জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ জানিয়েছি। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য গত বছরের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এবং মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর দপ্তরের মন্ত্রী চ টিন্ট সোয়ে চুক্তি সই করেন।
জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে সাড়ে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। নতুন ও পুরোনো মিলিয়ে বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। এদিকে বন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় অবস্থিত বনভূমি, বনজ সম্পদ, জীববৈচিত্র্যে পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় কমিটি গঠনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, বন বিভাগ থেকে শুরু করে জীববৈচিত্র্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও রোহিঙ্গা শিবিরের কারণে বন ধ্বংসের কথা বিভিন্ন সময় জানিয়েছে। তাদের পর্যবেক্ষণেও জীববৈচিত্র্য হুমকির চিত্র নানাভাবে উঠে এসেছে।
সর্বশেষ কক্সবাজার জেলায় রোহিঙ্গা শিবির স্থাপন নিয়ে জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিলের ‘দ্রুত পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন’ বলছে, রোহিঙ্গা শিবিরগুলো দেশের জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বসতি গড়ে ওঠার বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে সেখানে কিছু প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসভূমি চিরতরে হারিয়ে যাবে। বন আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে না। আর ভূমির ক্ষতিও অল্প সময়ে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। এই পরিস্থিতিতে শুধু বাংলাদেশ নয়, রোহিঙ্গা শিবিরগুলো বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্যের জন্যও এখন বড় হুমকি।