পাঁচ মাস ধরে অশান্ত পাহাড়

শক্তিমান চাকমা
শক্তিমান চাকমা

পাঁচ মাস ধরে পাহাড়ে চলছে খুনোখুনি। এলাকায় কর্তৃত্ব ধরে রাখা এবং নতুন করে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো। পাহাড়িরা যাকে বলছে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত। হঠাৎ করে খুনোখুনি বেড়ে চলার নেপথ্যে চাঁদাবাজি বড় কারণ বলে মনে করছেন সাধারণ পাহাড়িরা।

পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন চারটি আঞ্চলিক দল সক্রিয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), জেএসএস (এম এন লারমা), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। এর মধ্যে রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলায় সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতির কর্তৃত্ব প্রায় একচেটিয়া। খাগড়াছড়িতে দলটির তেমন কোনো অবস্থানই নেই। খাগড়াছড়ি এবং রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলায় পাহাড়ি রাজনীতির মূল নিয়ন্ত্রক ইউপিডিএফ। এর বাইরে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির কয়েকটি উপজেলায় কিছুটা অবস্থান রয়েছে জেএসএসের (এম এন লারমা)। ইউপিডিএফের সঙ্গে অলিখিত সমঝোতার ভিত্তিতে এত দিন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালাত জেএসএস (এম এন লারমা)।

হঠাৎ করে গত বছরের ১৫ নভেম্বর পাহাড়ের পরিস্থিতি পাল্টে যায়। সেদিন খাগড়াছড়িতে সংবাদ সম্মেলন করে আরেকটি দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ইউপিডিএফ ভেঙে কিছু নেতা-কর্মী ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গঠন করেন। এরপর থেকে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ধরে রাখা নিয়ে খুনোখুনির ঘটনা ঘটেছে। গত পাঁচ মাসে (গত ৫ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ৪ মে পর্যন্ত) খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে খুন হয়েছেন ১৭ জন।

পাহাড়ে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের বিষয়ে ইউপিডিএফের খাগড়াছড়ি জেলার সংগঠক মাইকেল চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, যা ঘটছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত। তাঁর দাবি, গণতান্ত্রিককে কেন্দ্র করেই এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তারা জেএসএসের (এম এন লারমা) কাছে আশ্রয় নিয়েছে। সংঘাত থামানোর জন্য জেএসএসের (এম এন লারমা) সঙ্গে আলোচনা করলেও দলটির নেতারা গুরুত্ব দেননি। ইউপিডিএফ আলোচনার মাধ্যমে সংঘাত বন্ধ করতে আগ্রহী।

পাহাড়ের আঞ্চলিক দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় ইউপিডিএফের সঙ্গে সমঝোতা ছিল জেএসএসের (এম এন লারমা)। কিন্তু ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গঠনের পর জেএসএসের (এম এন লারমা) সঙ্গে ইউপিডিএফের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এই দুই পক্ষের সঙ্গে বিরোধ শুরু হয় ইউপিডিএফের। যেসব এলাকায় ইউপিডিএফের কর্তৃত্ব রয়েছে, সেখানে গণতান্ত্রিকের সঙ্গে মিলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে জেএসএস (এম এন লারমা)। এই পরিস্থিতিতে জনসংহতি এবং ইউপিডিএফের মধ্যে পুরোনো যে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি ছিল, সেটা এখন কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছে।

জেএসএসের (এম এন লারমা) প্রচার বিভাগের দায়িত্বে থাকা সংগঠনটির নেতা প্রশান্ত চাকমা দাবি করেন, ইউপিডিএফের কারণে এখন পাহাড়ে সংঘাত হচ্ছে। ইউপিডিএফের সাংগঠনিক অদক্ষতার কারণে কিছু নেতা-কর্মী তাঁদের দল ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন। এখন এর দায় চাপানো হচ্ছে জেএসএসের ওপর।

ইউপিডিএফ ভেঙে যাওয়ায় ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বেড়ে যাবে এমন আশঙ্কার কথা গত নভেম্বর মাসে পাহাড়ি সমাজের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, ইউপিডিএফ এবং মূল জনসংহতি সমিতি এই দুটি দল যেসব এলাকায় শক্তিশালী, সেসব এলাকার স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে তাদের একধরনের বোঝাপড়া রয়েছে। তবে কয়েক বছর ধরে একক কোনো দল স্থানীয় প্রশাসনের আনুকূল্য পায় না।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইশফাক এলাহী চৌধুরী বলেন, দেশের অন্য এলাকার চেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতি ভিন্ন। পাহাড়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে। আগামী নির্বাচনের আগে পার্বত্য এলাকার ভূমি সমস্যাসহ অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধানে সরকারকে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। এ কাজটি সঠিকভাবে করা না গেলে যেকোনো পক্ষ সুযোগ নিতে পারে।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দুই দশকের সশস্ত্র লড়াই শেষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এ চুক্তি করে সরকারের সঙ্গে। তখন পর্যন্ত পাহাড়ে এই একটি দল ছিল। পরে চুক্তির বিরোধিতা করেই জনসংহতি সমিতির ছাত্রসংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের বড় একটি অংশ মূল দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে গঠন করে ইউপিডিএফ। দলটি গঠনের পরই জনসংহতির সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। ২০১০ সালে জনসংহতি থেকে কিছু নেতা-কর্মী বেরিয়ে জেএসএস (এম এন লারমা) নামে নতুন দল গঠন করেন। দুই সংগঠনের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে।

অন্যদিকে ২০০৩ সালে ইউপিডিএফ থকে প্রথমবারের মতো কয়েকজন নেতা দলত্যাগ করেন। তবে তাঁরা নতুন কোনো দল করেননি। এ ঘটনার প্রায় ১৪ বছর পর (গত বছরের ১৫ নভেম্বর) ভেঙে যায় ইউপিডিএফ। গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ নামে নতুন দলের আহ্বায়ক হন তপন জ্যোতি চাকমা। তাঁকে গত শুক্রবার গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়ার পথে সন্ত্রাসীদের গুলিতে তিনিসহ পাঁচজন প্রাণ হারান। আর বৃহস্পতিবার খুন হন শক্তিমান। তিনি জনসংহতির (এম এন লারমা) কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ছিলেন।

চলমান সংঘাতের বিষয়ে পাহাড়ের সবচেয়ে পুরোনো দল জনসংহতি সমিতির এক নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সংঘাত বন্ধ করার জন্য নানাভাবে তাঁরা চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে কোনো কোনো মহল পাহাড়ি একটি গোষ্ঠীকে ব্যবহার করছে। যে কারণে হানাহানি বন্ধ হচ্ছে না।

পাহাড়ে সক্রিয় প্রতিটি দলই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রায় নিয়মিতই চাঁদাবাজিতে জড়িত থাকার অভিযোগ তোলে। তিন পার্বত্য জেলার সরকারি প্রশাসনের কর্মকর্তারা এবং জনপ্রতিনিধিরাও বিভিন্ন সময়ে স্বীকার করেছেন, চাঁদাবাজি বন্ধ হলে পাহাড়ে সংঘাত এবং হানাহানি কমে যাবে। সাধারণ পাহাড়িরাও বলছেন, এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিভিন্ন দলের সংঘাতের মূল কারণ এখন চাঁদাবাজি। এ জন্য কোনো দলই নিজ এলাকার নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া করতে চায় না। এখন আর আদর্শ নেই, আছে শুধু ভাগ-বাঁটোয়ারার হিসাব।

আন্তর্জাতিক পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের কো-চেয়ার ও বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, পাহাড়ে অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার বিষয়টি একেবারে অপ্রত্যাশিত কোনো ঘটনা নয়। এর কারণ পার্বত্য চুক্তির পর পাহাড়ের সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট আন্তরিকভাবে সময়মতো সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ভূমি সমস্যার সমাধান হয়নি। স্থানীয় মানুষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না হওয়ায় সমস্যা বেড়েছে।

সুলতানা কামাল বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেকের অর্থনৈতিক স্বার্থ যুক্ত হয়ে গেছে। আধিপত্য বিস্তারের প্রশ্নটিও এড়িয়ে যাওয়ার নয়। বহিরাগত স্বার্থও ঢুকে গেছে। আবার কোনো কোনো মহল আঞ্চলিক দলগুলোর ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে উসকে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছে। সরকার আন্তরিকভাবে চাইলে পার্বত্য চুক্তির মূল ধারাগুলো বাস্তবায়ন করে পাহাড়ের সমস্যার সমাধান করতে পারে। সেখানে সন্ত্রাস বন্ধে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।